পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বিনোদিনী উঠিল। অভিমানী মহেন্দ্ৰ বাধা না দিয়া কহিল, “কোথায় যাইতেছ।” বিনোদিনী কহিল, “কাজ আছে।” বলিয়া ধীরপদে চলিয়া গেল। কাছ পর্যন্ত গিয়াই ফিরিয়া আসিয়া একলা ছাদে বেড়াইতে লাগিল । বিনোদিনী অহরহ আকর্ষণও করে, অথচ বিনোদিনী এক মুহূর্ত কাছে আসিতেও দেয় না। অন্যে তাহাকে জিনিতে পারে না, এ গর্ব মহেন্দ্রের ছিল, তাহা সে সম্প্রতি বিসর্জন দিয়াছে- কিন্তু চেষ্টা করিলেই অন্যকে সে জিনিতে পারে, এ গর্বটুকুও কি রাখিতে পরিবে না। আজ সে হার মানিল, অথচ হার মানাইতে পারিল না। হৃদয়ক্ষেত্ৰে মহেন্দ্রের মাথা বড়ো উচেই ছিল— সে কাহাকেও আপনার সমকক্ষ বলিয়া জানিত না- আজ সেইখানেই তাহাকে ধূলায় মাথা লুটাইতে হইল। যে শ্রেষ্ঠতা হারাইল তাহার বদলে কিছু পাইলও না। ভিক্ষুকের মতো রুদ্ধ দ্বারের সম্মুখে সন্ধ্যার সময় রিক্তহস্তে পথে দাড়াইয়া থাকিতে হইল। ফাঙ্গুন-চৈত্রমাসে বিহারীদের জমিদারি হইতে সরষে-ফুলের মধু আসিত, প্রতি বৎসরই সে তাহা রাজলক্ষ্মীকে পাঠাইয়া দিত— এবারও পাঠাইয়া দিল । বিনোদিনী মধুভাণ্ড লইয়া স্বয়ং রাজলক্ষ্মীর কাছে গিয়া কহিল, “পিসিমা, বিহারী-ঠাকুরপো মধু পাঠাইয়াছেন।” রাজলক্ষ্মী তাহা ভাড়ারে তুলিয়া রাখিতে উপদেশ দিলেন। বিনোদিনী মধু তুলিয়া আসিয়া রাজলক্ষ্মীর কাছে বসিল । কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো কখনো তোমাদের তত্ত্ব লাইতে ভোলেন না। বেচারার নিজের মা নাই নাকি, তাই তোমাকেই মার মতো দেখেন ।” বিহারীকে রাজলক্ষ্মী এমনি মহেন্দ্রের ছায়া বলিয়া জানিতেন যে, তাহার কথা তিনি বিশেষ-কিছু ভাবিতেন না— সে তাঁহাদের বিনা-মূল্যের বিনা-যত্নের বিনা-চিন্তার অনুগত লোক ছিল। বিনোদিনী যখন রাজলক্ষ্মীকে মাতৃহীন বিহারীর মাতৃস্থানীয়া বলিয়া উল্লেখ করিল, তখন রাজলক্ষ্মীর মাতৃহৃদয় অকস্মাৎ স্পর্শ করিল। হঠাৎ মনে হইল, “তা বটে, বিহারীর মা নাই এবং আমাকেই সে মার মতো দেখে।” মনে পড়িল, রোগে তাপে সংকটে বিহারী বরাবর বিনা আহবানে, বিনা আড়ম্বরে তাহাকে নিঃশব্দ নিষ্ঠার সহিত সেবা করিয়াছে ; রাজলক্ষ্মী তাহা নিশ্বাসপ্ৰশ্বাসের মতো সহজে গ্রহণ করিয়াছেন এবং সেজন্য কাহারও কাছে কৃতজ্ঞ হওয়ার কথা তাহার মনেও উদয় হয় নাই। কিন্তু বিহারীর খোঁজখবর কে রাখিয়াছে। যখন অন্নপূর্ণা ছিলেন তিনি রাখিতেন বটে— রাজলক্ষ্মী ভাবিতেন, “বিহারীকে বশে রাখিবার জন্য অন্নপূর্ণা মেহের আড়ম্বর করিতেছেন।” রাজলক্ষ্মী আজ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “বিহারী আমার আপনি ছেলের মতোই বটে।” বলিয়াই মনে উদয় হইল, বিহারী তাহার আপনি ছেলের চেয়ে ঢের বেশি করে- এবং কখনো বিশেষ কিছু প্ৰতিদান না পাইয়াও তাঁহাদের প্রতি সে ভক্তি স্থির রাখিয়াছে। ইহা ভাবিয়া তাহার অন্তরের মধ্য হইতে দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল । বিনোদিনী কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো তোমার হাতের রান্না খাইতে বড়ো ভালোবাসেন।” রাজলক্ষ্মী সমেহগর্বে কহিলেন, “আর-কারও মাছের ঝোল তাহার মুখে রোচে না।” আজকাল দেখিতে পাই না কেন।” বিনোদিনী কহিল, “আমিও তো তাই ভাবিতেছিলাম, পিসিমা । তা, তোমার ছেলেটি বিবাহের পর হইতে নিজের বউকে লইয়াই এমনি মাতিয়া রহিয়াছে— বন্ধুবান্ধবরা আসিয়া আর কী করিবে বলো ৷” কথাটা রাজলক্ষ্মীর অত্যন্ত সংগত বোধ হইল। স্ত্রীকে লইয়া মহেন্দ্ৰ তাহার সমস্ত হিতৈষীদের দূর করিয়াছে। বিহারীর তো অভিমান হইতেই পারে— কেন সে আসিবে। বিহারীকে নিজের দলে পাইয়া তাহার প্রতি রাজলক্ষ্মীর সমবেদনা বাড়িয়া উঠিল। বিহারী যে ছেলেবেলা হইতে একান্ত নিঃস্বার্থভাবে