পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 88s মহেন্দ্রের খাওয়ায় মনোযোগ ছিল না, সে কেবল পরিবেশনে পক্ষপাত লক্ষ করিতে লাগিল । মহেন্দ্রের মনে হইল, বিহারীকে পরিবেশন করিয়া বিনোদিনী যেন একটা বিশেষ সুখ পাইতেছে। বিহারীর পাতেই যে বিশেষ করিয়া মাছের মুড়া ও দধির সর পড়িল, তাহার উত্তম কৈফিয়ত ছিল— মহেন্দ্র ঘরের ছেলে, বিহারী নিমন্ত্রিত। কিন্তু মুখ ফুটিয়া নালিশ করিবার ভালো হেতুবাদ ছিল না বলিয়াই মহেন্দ্র আরো বেশি করিয়া জ্বলিতে লাগিল। অসময়ে বিশেষ সন্ধানে তপসিমাছ পাওয়া গিয়াছিল, তাহার মধ্যে একটি ডিমওয়ালা ছিল ; সেই মাছটি বিনোদিনী বিহারীর পাতে দিতে গেলে বিহারী কহিল, “না না, মহিনদাকে দাও, মহিনদা ভালোবাসে ।” মহেন্দ্ৰ তীব্ৰ অভিমানে বলিয়া উঠিল, “না না, আমি চাই না।” শুনিয়া বিনোদিনী দ্বিতীয় বার অনুরোধ মাত্র না করিয়া সে-মাছ বিহারীর পাতে ফেলিয়া দিল । “বিহারী-ঠাকুরপো, এখনই যাইয়ো না, উপরের ঘরে একটু বসিবে চলো।” বিহারী কহিল, “তুমি খাইতে যাইবে না ?” বিনোদিনী কহিল, “না, আজ একাদশী ।” * নিষ্ঠুর বিদ্রুপের একটি সূক্ষ্ম হাস্যরেখা বিহারীর ওষ্ঠপ্ৰান্তে দেখা দিল— তাহার অর্থ এই যে, একাদশী-করাও আছে। অনুষ্ঠানের ত্রুটি নাই। সেই হাস্যের আভাসটুকু বিনোদিনীর দৃষ্টি এড়ায় নাই— তবু সে যেমন তাহার হাতের কাটা ঘা সহা করিয়াছিল, তেমনি করিয়া ইহাও সহ্য করিল। নিতান্ত মিনতির স্বরে কহিল, “আমার মাথা খাও, একবার বসিবে চলো ।” মহেন্দ্ৰ হঠাৎ অসংগতভাবে উত্তেজিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “তোমাদের কিছুই তো বিবেচনা নাই— কাজ থাক কৰ্ম থাক, ইচ্ছা থাক বা না থাক, তবু বসিতেই হইবে। এত অধিক আদরের আমি তো কোনো মানে বুঝিতে পারি না।” বিনোদিনী উচ্চহাস্যা করিয়া উঠিল। কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, শোনো একবার, তোমার মহিনদার কথা শোনো। আদরের মানে আদর, অভিধানে তাহার' আর কোনো দ্বিতীয় মানে লেখে না।” ( মহেন্দ্রের প্রতি ) “যাই বল ঠাকুরপো, অধিক আদরের মানে শিশুকাল হইতে তুমি যত পরিষ্কার বোঝ, এমন আর কেহ বোঝে না ।” বিহাবী কহিল, “মহিনদা, একটা কথা আছে, একবার শুনিয়া যাও।” বলিয়া বিহারী বিনোদিনীকে কোনো বিদায়সম্ভাষণ না করিয়া মহেন্দ্ৰকে লইয়া বাহিরে গেল। বিনোদিনী বারান্দায় রেলিং ধরিয়া চুপ বিহারী বাহিরে আসিয়া কহিল, “মহিনদা, আমি জানিতে চাই, এইখানে কি আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হইল।” মহেন্দ্রের বুকের ভিতর তখন জ্বলিতেছিল, বিনোদিনীর পরিহাস-হাস্য বিদ্যুৎ শিখার মতো তাহার মস্তিষ্কের এক প্ৰান্ত হইতে আর-এক প্ৰান্ত বারংবার ফিরিয়া ফিরিয়া বিধিতেছিল- সে কহিল, “মিটমাট হইলে তোমার তাহাতে বিশেষ সুবিধা হইতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তাহা প্রার্থনীয় বোধ হয় না। আমার সংসারের মধ্যে আমি বাহিরের লোক ঢুকাইতে চাই না— আন্তঃপুরকে আমি অন্তঃপুর রাখিতে চাই।” বিহারী কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল। ঈর্ষাজর্জর মহেন্দ্র একবার প্রতিজ্ঞা করিল, “বিনোদিনীর সঙ্গে দেখা করিব না’- তাহার পরে বিনোদিনীর সহিত সাক্ষাতের প্রত্যাশায় ঘরে-বাহিরে, উপরে-নীচে ছটফট করিয়া বেড়াইতে লাগিল। SR li SRS