পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8१७ পডিয়াছে। তখন, কেমন করিয়া অগ্রসর হইবে ভাবিয়া পাইল না। বিচ্ছেদের পর কিছুক্ষণ একটা নূতন লজ্জা আসে- যেখানটিতে ছাড়িয়া যাওয়া যায় ঠিক সেইখানটিতে মিলিবার পূর্বে পরস্পর পরস্পরের নিকট হইতে নূতন সম্ভাষণের প্রত্যাশা করে। আশা তাহার সেই চিরপরিচিত আনন্দশয্যাটিতে আজ অনাহূত কেমন করিয়া প্ৰবেশ করিবে। দ্বারের কাছে অনেকক্ষণ দাড়াইয়া রহিল— মহেন্দ্রের কোনো সাড়া পাইল না। অত্যন্ত ধীরে ধীরে এক পা এক পা করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল। যদি অসতর্কে দৈবাৎ কোনো গহনা বাজিয়া উঠে তো সে লজায় মরিয়া যায়। কম্পিতহীদয়ে আশা মশারির কাছে আসিয়া অনুভব করিল, মহেন্দ্ৰ ঘুমাইতেছে। তখন তাহার নিজের সাজসজা তাহাকে সর্বাঙ্গে বেষ্টন করিয়া পরিহাস করিতে লাগিল । ইচ্ছা হইল, বিদ্যুদবেগে এ ঘর হইতে বাহির হইয়া অন্য কোথাও গিয়া শোয় । আশা যথাসাধ্য নিঃশব্দে সংকুচিত হইয়া খাটের উপর গিয়া উঠিল। তবু তাহাতে এতটুকু শব্দ ও নড়াচড়া হইল যে, মহেন্দ্ৰ যদি সত্যই ঘুমাইত, তাহা হইলে জাগিয়া উঠিত। কিন্তু আজ তাহার চক্ষু খুলিল না, কেননা, মহেন্দ্ৰ ঘুমাইতেছিল না। মহেন্দ্ৰ খাটের অপর প্রান্তে পােশ ফিরিয়া শুইয়া ছিল, সুতরাং আশা তাহার পশ্চাতে শুইয়া রহিল। আশা যে নিঃশব্দে অশ্রুপাত করিতেছিল, তাহা পিছন ফিরিয়াও মহেন্দ্ৰ স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছিল। নিজের নিষ্ঠুরতায় তাহার হৃৎপিণ্ডটাকে যেন জাতার মতো পেষণ করিয়া ব্যথা দিতেছিল। কিন্তু কী কথা বলিবে, কেমন করিয়া আদর করিবে, মহেন্দ্ৰ তাহা কোনোমতেই ভাবিয়া পাইল না ; মনে মনে নিজেকে সুতীব্র কশাঘাত করিতে লাগিল, তাহাতে আঘাত পাইল, কিন্তু উপায় পাইল না। ভাবিল, “প্ৰাতঃকালে তো ঘুমের ভান করা যাইবে না, তখন মুখোমুখি হইলে আশাকে কী কথা বলিব ।” আশা নিজেই মহেন্দ্রের সে সংকট দূর করিয়া দিল। সে অতি প্ৰত্যুষেই অপমানিত সাজসজ্জা লইয়া বিছানা ছাড়িয়া চলিয়া গেল, সে-ও মহেন্দ্ৰকে মুখ দেখাইতে পারিল না। \) আশা ভাবিতে লাগিল, “এমন কেন হইল। আমি কী করিয়াছি।” যে জায়গায় যথার্থ বিপদ, সে জায়গায় তাহার চোখ পড়িল না। বিনোদিনীকে যে মহেন্দ্ৰ ভালোবাসিতে পারে, এ সম্ভাবনাও তাহার মনে উদয় হয় নাই। সংসারের অভিজ্ঞতা তাহার কিছুই ছিল না। তা ছাড়া বিবাহের অনতিকাল পর হইতে সে মহেন্দ্ৰকে যাহা বলিয়া নিশ্চয় জানিয়াছিল, মহেন্দ্ৰ যে তাহা ছাড়া আর কিছুই হইতে পারে, ইহা তাহার কল্পনাতেও আসে নাই। মহেন্দ্র আজ সকাল সকাল কলেজে গেল। কলেজ যাত্রাকালে আশা বরাবর জানলার কাছে আসিয়া দাড়াইত, এবং মহেন্দ্ৰ গাড়ি হইতেই একবার মুখ তুলিয়া দেখিত, ইহা তাহাদের চিরকালের নিত্য প্রথা ছিল। সেই অভ্যাস অনুসারে গাড়ির শব্দ শুনিবা মাত্র যন্ত্রচালিতের মতো আশা জানলার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। মহেন্দ্ৰও অভ্যাসের খাতিরে একবার চকিতের মতো উপরে চোখ তুলিল ; দেখিল, আশা দাড়াইয়া আছে— তখনো তাহার স্নান হয় নাই, মলিন বস্ত্ৰ, অসংযত কেশ, শুষ্ক মুখ- দেখিয়া নিমেষের মধ্যেই মহেন্দ্ৰ চােখ নামাইয়া কোলের বই দেখিতে লাগিল। কোথায় চোখে চোখে সেই নীরব সম্ভাষণ, সেই ভাষাপূর্ণ হাসি ! গাড়ি চলিয়া গেল; আশা সেইখানেই মাটির উপর বসিয়া পড়িল। পৃথিবী সংসার সমস্ত বিস্বাদ হইয়া গেল। কলিকাতার কর্মপ্রবাহে তখন জোয়ার আসিবার সময়। সাড়ে দশটা বাজিয়াছে— আপিসের গাড়ির বিরাম নাই, ট্রামের পশ্চাতে ট্রাম ছুটিতেছে- সেই ব্যস্ততা বেগবান কর্মকল্লোলের অদূরে এই একটি বেদনাস্তম্ভিত মুহ্যমান হৃদয় অত্যন্ত বিসদৃশ। হঠাৎ এক সময় আশার মনে হইল, “বুঝিয়াছি। ঠাকুরপো কাশী গিয়াছিলেন, সেই খবর পাইয়া উনি রাগ করিয়াছেন। ইহা ছাড়া ইতিমধ্যে আর তো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নাই। কিন্তু আমার