পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8Wじ と রবীন্দ্র-রচনাবলী একেবারে নিঃস্ব ভিখারীর মতো পথে আসিয়া দাড়াইয়াছে, সেই মুহুর্তে বিহারী কি এমন অযাচিত অজস্র প্রেমের উপহার সমস্ত হৃদয়ের সহিত উপেক্ষা করিয়া ফেলিয়া দিতে পারে। ইহার তুলনায় বিহারী কী পাইয়াছে। এতদিন পর্যন্ত সমস্ত জীবন উৎসর্গ করিয়া সে কেবল প্ৰেম-ভাণ্ডারের খুদকুড়া ভিক্ষা করিতেছিল । প্রেমের অন্নপূর্ণা সোনার থালা ভরিয়া আজ একা তাহারই জন্য যে ভোজ পাঠাইয়াছেন, হতভাগ্য কিসের দ্বিধায় তাহা হইতে নিজেকে বঞ্চিত করিবে । ছবি কোলে লইয়া এইরকম নানা কথা যখন সে একমনে আলোচনা করিতেছিল, এমন সময় পাৰ্থে শব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিয়া দেখিল মহেন্দ্ৰ আসিয়াছে। চকিত হইয়া দাড়াইয়া উঠিতেই কোল হইতে ছবিখানি নীচে কাপেটের উপর পড়িয়া গেল— বিহারী তাহা লক্ষ করিল না। মহেন্দ্ৰ একেবারেই বলিয়া উঠিল, “বিনোদিনী কোথায়।” । সকল কথার আলোচনা করা যাইতেছে।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “আমার বসিবার এবং আলোচনা করিবার সময় নাই। বিলো, বিনোদিনী কোথায় ।” বিহারী কহিল, “তুমি যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করিতেছ, এক কথায় তাহার উত্তর দেওয়া চলে না। একটু তোমাকে স্থির হইয়া বসিতে হইবে ।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “উপদেশ দিবে ? সে-সব উপদেশের কথা আমি শিশুকালেই পডিয়াছি।” বিহারী । না, উপদেশ দিবার অধিকার ও ক্ষমতা আমার নাই । মহেন্দ্ৰ। ভৎসনা করিবে ? আমি জানি আমি পাষণ্ড, আমি নিরাধম এবং তুমি যাহা বলিতে চাও তাহা সবই। কিন্তু কথা এই, তুমি জান কি না, বিনোদিনী কোথায়। বিহারী। জানি । মহেন্দ্ৰ। আমাকে বলিবে কি না। বিহারী । না। মহেন্দ্ৰ। বলিতেই হইবে। তুমি তাহাকে চুরি করিয়া আনিয়া লুকাইয়া রাখিয়াছ। সে আমার, তাহাকে ফিরাইয়া দাও । বিহারী ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া রহিল। তাহার পর দৃঢ়স্বরে বলিল, “ সে তোমার নহে। আমি তাহাকে চুরি করিয়া আনি নাই, সে নিজে আমার কাছে আসিয়া ধরা দিয়াছে।” মহেন্দ্ৰ গৰ্জন করিয়া উঠিল, “মিথ্যা কথা !” এই বলিয়া পাশ্ববর্তী ঘরের রুদ্ধ দ্বারে আঘাত দিতে দিতে উচ্চস্বরে ডাকিল, “বিনোদ, বিনোদ !” ঘরের ভিতর হইতে কান্নার শব্দ শুনিতে পাইয়া বলিয়া উঠিল, “ভয় নাই বিনোদ ! আমি মহেন্দ্ৰ, আমি তোমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাইব- কেহ তোমাকে বন্ধ করিয়া রাখিতে পরিবে না।” বলিয়া মহেন্দ্র সবলে দ্বারে ধাক্কা দিতেই দ্বার খুলিয়া গেল। ভিতরে ছুটিয়া গিয়া দেখিল, ঘরে করিয়া বালিশ চাপিয়া ধরিল। বিহারী তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া বসন্তকে বিছানা হইতে কোলে তুলিয়া সান্তনার স্বরে বলিতে লাগিল, “ভয় নাই বসন্ত, ভয় নাই, কোনো ভয় নাই।” মহেন্দ্র তখন দ্রুতপদে বাহির হইয়া বাড়ির সমস্ত ঘর দেখিয়া আসিল। যখন ফিরিয়া আসিল, তখনো বসন্ত ভয়ের আবেগে থাকিয়া থাকিয়া কাদিয়া উঠিতেছিল, বিহারী তাহার ঘরে আলো জ্বালিয়া তাহাকে বিছানায় শোয়াইয়া গায়ে হাত বুলাইয়া তাহাকে ঘুম পাড়াইবার চেষ্টা করিতেছিল। মহেন্দ্ৰ আসিয়া কহিল, “বিনোদিনীকে কোথায় রাখিয়াছ।” বিহারী কহিল, “মহিনদা, গোল করিয়ো না, তুমি অকারণে এই বালককে যেরূপ ভয় পাওয়াইয়া দিয়াছ, ইহার অসুখ করিতে পারে। আমি বলিতেছি, বিনোদিনীর খবরে তোমার কোনো প্রয়োজন नाई।" মহেন্দ্ৰ কহিল, “সাধু! মহাত্মা ! ধর্মের আদর্শ। খাড়া করিয়ো না। আমার স্ত্রীর এই ছবি কোলে