পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 じbr রবীন্দ্র-রচনাবলী স্নান করিতে উদ্যত হইয়াছে, এমন সময় চিঠির ব্যাগ লইয়া পেয়াদাকে পথ দিয়া যাইতে দেখিয়া বিনোদিনী আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না। গামছা ফেলিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া গিয়া তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “পাচুদাদা, আমার চিঠি আছে ?” বুড়া কহিল, “না।” বিনোদিনী ব্যগ্ৰ হইয়া কহিল, “ থাকিতেও পারে। একবার দেখি ।” "w বলিয়া পাড়ার অল্প খান-পাচ-ছয় চিঠি লইয়া উলটাইয়া-পালটাইয়া দেখিল, কোনোটাই তাহার নহে। বিমর্ষমুখে যখন ঘাটে ফিরিয়া আসিল, তখন তাহার কোনো সখী সকৌতুক কটাক্ষে কহিল, “কী লো বিন্দি, চিঠির জন্যে এত ব্যস্ত কেন।” আর-এক জন প্ৰগলভা কহিল, “ভালো ভালো, ডাকের চিঠি আসে এত ভাগ্য কয়জনের। আমাদের তো স্বামী, দেবর, ভাই বিদেশে কাজ করে। কিন্তু ডাকের পেয়াদার দয়া হয় না।” এইরূপে কথায় কথায় পরিহাস স্মৃষ্টিতর ও কটাক্ষ তীক্ষতর হইয়া উঠিতে লাগিল। বিনোদিনী বিহারীকে অনুনয় করিয়া আসিয়াছিল, প্রত্যহ যদি নিতান্ত না ঘটে, তবে অন্তত সপ্তাহে দুইবার তাহাকে কিছু নাহয় তো দুই ছত্রও যেন চিঠি লেখে। আজই বিহারীর চিঠি পাইবার সম্ভাবনা অতান্ত বিরল, কিন্তু আকাঙক্ষা এত অধিক হইয়া উঠিল যে, দূর সম্ভাবনার আশাও বিনোদিনী ছাড়িতে পারিল না ! তাহার মনে হইতে লাগিল, যেন কতকাল কলিকাতা ত্যাগ করিয়াছে । মহেন্দ্রের সহিত জডিত করিয়া বিনোদিনীর নামে নিন্দা গ্রামের ঘরে ঘরে কিরূপ ব্যাপ্ত হইয়া পডিয়াছে, শত্ৰু-মিত্রের কৃপায় বিনোদিনীর কাছে তাহা অগোচর রহিল না ; শান্তি কোথায় । গ্রামবাসী সকলের কাছ হইতে বিনোদিনী নিজেকে নির্লিপ্ত কবিয়া লইতে চেষ্টা করিল। পল্লীর লোকেরা তাহাতে আরো রাগ করিল। পাতাকিনীকে কাছে লইয়া ঘূণা ও পীড়ন করিবার বিলাস সুখ হইতে তাহারা বঞ্চিত হইতে চায় না । ক্ষুদ্র পল্লীর মধ্যে নিজেকে সকলের কাছ হইতে গোপন রাখিবার চেষ্টা বৃথা । এখানে আহত হৃদয়টিকে কোণের অন্ধকারে লইয়া নির্জনে শুশ্ৰষা করিবার অবকাশ নাই- যেখান—সেখান হইতে সকলের তীক্ষ কৌতুহলদৃষ্টি আসিয়া ক্ষতস্থানে পতিত হয়--- বিনোদিনীর অন্তঃপ্রকৃতি চুপড়ির ভিতরকার সজীৱ মাছের মতো যতই আছড়াইতে লাগিল, ততই চারি দিকের সংকীর্ণতার মধ্যে নিজেকে বারংবার আহত করিতে লাগিল। এখানে স্বাধীনভাবে পরিপূর্ণরূপে বেদনাভোগ করিবারও স্থান নাই । দ্বিতীয় দিনে চিঠি পাইবার সময় উত্তীণ হইতেই বিনোদিনী ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া লিখিতে বসিল— "ঠাকুরপো, ভয় করিয়ো না, আমি তোমাকে প্রমের চিঠি লিখিতে বসি নাই । তুমি আমার বিচারক, আমি তোমাকে প্ৰণাম করি। আমি যে পাপ করিয়াছি, তুমি তাহার কঠিন দণ্ড দিয়াছ ; তোমার আদেশমাত্র সে দণ্ড আমি মাথায় করিয়া বহন করিয়াছি। দুঃখ এই দণ্ডটি যে কত কঠিন, তাহা তুমি দেখিতে পাইলে না। যদি দেখিতে, যদি জানিতে পাইতে, তাহা হইলে তোমার মনে যে -দয়া হইত। তাহা হইতেও বঞ্চিত হইলাম। তোমাকে স্মরণ করিয়া, মনে মনে তোমার দুইখানি পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া, আমি ইহাও সহ্য করিব। কিন্তু প্ৰভু, জেলখানার কয়েদি কি আহারও পায় না। শৌখিন আহার নহে— যতটুকু না হইলে তাহার প্রাণ বঁাচে না, সেটুকুও তো বরাদ আছে। তোমার দুই ছাত্র চিঠি আমার এই নির্বাসনের আহার— তাহা যদি না পাই, তবে আমার কেবল নির্বাসনদণ্ড নহে, প্ৰাণদণ্ড । আমাকে এত অধিক পরীক্ষা করিয়ো না, দণ্ডদাতা ! আমার পাপমনে অহংকারের সীমা ছিল না— কাহারও কাছে আমাকে এমন করিয়া মাথা নোয়াইতে হইবে, ইহা আমি স্বপ্নেও জানিতাম না । তোমার জয় হইয়াছে, প্ৰভু ; আমি বিদ্রোহ করিব না। কিন্তু আমাকে দয়া করো— আমাকে বাচিতে দাও । এই অরণাবাসের সম্বল আমাকে অল্প-একটু করিয়া দিয়ে। তাহা হইলে তোমার শাসন হইতে আমাকে কেহই কিছুতেই টলাইতে পরিবে না। এইটুকু দুঃখের কথাই জানাইলাম। আর যে-সব কথা