পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৭

8 Գ Օ রবীন্দ্র-রচনাবলী \SS) পাড়ায় ভারি একটা গোলমাল পড়িয়া গেল। পল্লীবৃদ্ধের চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া কহিল, “এ কখনোই সহ্য করা যাইতে পারে না। কলিকাতায় কী ঘটিতেছিল, তাহা কানে না তুলিলেও চলিত, কিন্তু এমন সাহস যে মহেন্দ্ৰকে চিঠির উপর চিঠি লিখিয়া পাড়ায় আনিয়া এমন প্ৰকাশ্য নির্লজক্ততা ! এরূপ ভ্ৰষ্টাকে গ্রামে রাখিলে তো চলিবে না।” হুকুম শুনিতে গেলাম। আমি কেন তাহাকে বুঝিতে দিলাম যে, সে আমার প্রতি যেমন বিধান করিবে আমি তাহাই নতশিরে গ্রহণ করিব। তাহার ভালোবাসার আশাকে বাচাইবার জন্য যেটুকু দরকার, আমার সঙ্গে কেবলমাত্র তাহার সেইটুকু সম্পর্ক ? আমার নিজের কোনো প্ৰাপ্য নাই, দাবি নাই, সামান্য দুই ছত্ৰ চিঠিও না— আমি এত তুচ্ছ, এত ঘূণার সামগ্ৰী ?” তখন ঈর্ষার বিষে বিনোদিনীর সমস্ত বক্ষ পূর্ণ হইয়া উঠিল— সে কহিল, “আর-কাহারও জন্য এত দুঃখ সহ্য করা যাইতে পারে, কিন্তু তাই বলিয়া আশার জন্য নয়। এই দৈনা, এই বনবাস, এই লোকনিন্দা, এই অবজ্ঞা, এই জীবনের সকলপ্রকার অপরিতৃপ্তি, কেবল আশারই জন্য আমাকে বহন করিতে হইবে— এতবড়ো ফাকি কেন আমি মাথায় করিয়া লইলাম। কেন আমার সর্বনাশের ব্ৰত সম্পূৰ্ণ করিয়া আসিলাম না। নির্বোধ, আমি নির্বোধ। আমি কেন বিহারীকে ভালোবাসিলাম।” বিনোদিনী যখন কাঠের মূর্তির মতো ঘরের মধ্যে কঠিন হইয়া বসিয়া ছিল, এমন সময় তাহার দিদিশাশুড়ি জামাইবাড়ি হইতে ফিরিয়া আসিয়াই তাহাকে কহিল, “ পোড়ারমুখী, কী সব কথা শুনিতেছি।” বিনোদিনী কহিল, “যাহা শুনিতেছ। সবই সত্য কথা ।” দিদিশাশুড়ি। তবে এ কলঙ্ক পাড়ায় বহিয়া আনিবার কী দরকার ছিল— এখানে কেন আসিলি । রুদ্ধ ক্ষোভে বিনোদিনী চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। দিদিশাশুড়ি কহিল, “বাছা, এখানে তোমার থাকা হইবে না, তাহা বলিতেছি। পোড়া অদৃষ্টে আমার সবাই মরিয়া-ঝরিয়া গেল, ইহাও সহ্য করিয়া বাচিয়া আছি, কিন্তু তাই বলিয়া এ-সকল ব্যাপার আমি সহিতে পারিব না। ছি ছি, আমাদের মাথা হেট করিলে। তুমি এখনই যাও।” বিনোদিনী কহিল, “আমি এখনই যাইব ।” এমন সময় মহেন্দ্ৰ, স্নান নাই, আহার নাই, উষ্ক খুষ্ক চুল করিয়া হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হইল। সমস্ত রাত্রির অনিদ্রায় তাহার চক্ষু রক্তবর্ণ, মুখ শুষ্ক। অন্ধকার থাকিতেই ভোরে আসিয়া সে বিনোদিনীকে লইয়া যাইবার জন্য দ্বিতীয় বার চেষ্টা করিবে, এইরূপ তাহার সংকল্প ছিল। কিন্তু পূর্বদিনে বিনোদিনীর অভূতপূর্ব ঘূণার অভিঘাত পাইয়া তাহার মনে নানাপ্রকার দ্বিধার উদয় হইতে লাগিল। ক্রমে যখন বেলা হইয়া গেল, রেলগাড়ির সময় আসন্ন হইয়া আসিল, তখন স্টেশনের যাত্ৰিশালা হইতে বিনোদিনীর দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। লজ্জা ত্যাগ করিয়া প্ৰকাশ্য দুঃসাহসের কাজ করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে যে একটা স্পর্ধাপূর্ণ বল জন্মে, সেই বলের আবেগে মহেন্দ্র একটা উদভ্ৰান্ত আনন্দ বোধ করিল— তাহার সমস্ত অবসাদ ও দ্বিধা চুৰ্ণ হইয়া গেল। গ্রামের কৌতুহলী লোকগুলি তাহার উন্মত্ত দৃষ্টিতে ধূলির নিজীব পুত্তলিকার মতো বোধ লইল। মহেন্দ্ৰ কোনোদিকে দৃকপাতমাত্র না করিয়া একেবারে বিনোদিনীর কাছে আসিয়া কহিল, “বিনোদ, লোকনিন্দার মুখে তোমাকে একলা ফেলিয়া যাইব, এমন কাপুরুষ আমি নহি। তোমাকে যেমন করিয়া হউক, এখান হইতে লইয়া যাইতেই হইবে। তাহার পরে তুমি আমাকে পরিত্যাগ করিতে চাও, পরিত্যাগ করিয়ো, আমি তোমাকে কিছুমাত্র বাধা দিব না। আমি তোমাকে স্পর্শ করিয়া আজ শপথ করিয়া বলিতেছি, তুমি যখন যেমন ইচ্ছা কর তাঁহাই