পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 Գ Տ) নাই, সেই বিশ্বাস, সেই প্ৰেম, সেই সহজ আনন্দ ! কিন্তু হায়, জগৎসংসারে সেইটুকুমাত্র জায়গায় ফিরিবার পথ আর নাই। এই ছাদে আশার পাশে মাদুরের একটুখানি ভাগ মহেন্দ্ৰ একেবারে হাবাইয়াছে। এতদিন বিনোদিনীর সঙ্গে মহেন্দ্রের অনেকটা স্বাধীন সম্বন্ধ ছিল। ভালোবাসিবার উন্মত্ত সুখ ছিল, কিন্তু তাহার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন ছিল না। এখন মহেন্দ্ৰ বিনোদিনীকে সমাজ হইতে স্বহস্তে ছিন্ন কবিয়া আনিয়াছে, এখন আর বিনোদিনীকে কোথাও রাখিবার, কোথাও ফিরাইয়া দিবার জায়গা নাই-- মহেন্দ্ৰই তাহার একমাত্র নির্ভর। এখন ইচ্ছা থাক বা না থাক, বিনোদিনীর সমস্ত ভার তাহাকে বহন করিতেই হইবে। এই কথা মনে করিয়া মহেন্দ্রের হৃদয় ভিতরে ভিতরে পীড়িত হইতে লাগিল । তাহাদের ছাদের উপরকার এই ঘরকন্না, এই শান্তি, এই বাধাবিহীন দাম্পতামিলনের নিভৃত রাত্রি, হঠাৎ মহেন্দ্রের কাছে বড়ো আরামের বলিয়া বোধ হইল। কিন্তু এই সহজসুলভ আরাম, যাহাতে একমাত্র তাহারই অধিকার, তাহাই আজি মহেন্দ্রের পক্ষে দুরাশার সামগ্ৰী । চিরজীবনের মতো যে-বোঝা সে মাথায় তুলিয়া লইয়াছে, তাহা নামাইয়া মহেন্দ্ৰ এক মুহূর্তও ইপি ছাড়িতে পরিবে না। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মহেন্দ্র একবার আশার দিকে চাহিয়া দেখিল। নিস্তব্ধ রোদনে বক্ষ পরিপূর্ণ কবিয়া আশা তখনো নিশ্চল হইয়া বসিয়া আছে — রাত্রির অন্ধকার জননীৰ অঞ্চলের নায় তাহার লজ ও বেদনা আবৃত করিয়া রাখিয়াছে । মহেন্দ্ৰ পায়চারি ভঙ্গ করিয়া কী বলিবার জন্য হঠাৎ আশার কাছে আসিয়া দাড়াইল । সমস্ত শরীরের রক্ত আশার কানের মধ্যে গিয়া শব্দ করিতে লাগিল, সে চক্ষু মুদ্রিত করিল। মহেন্দ্র কী বলিতে আসিয়াছিল, ভাবিয়া পাইল না, তাহার কীই বা বলিবার আছে। কিন্তু কিছু-একটা না বলিয়া আর ফিরিতে পাবিল না । বলিল, "চাবির গোছাটা কোথায় ।” চাবিব গোছা ছিল বিছানার গদিন্টার নীচে । আশা উঠিয়া ঘরের মধো গেল।-- মহেন্দ্ৰ তাহার অনুসরণ করিল। গাদির নীচে হইতে চাবি বাহির করিয়া আশা গদির উপরে রাখিয়া দিল ! মহেন্দ্ৰ চাবির গোছা লইয়া নিজের কাপড়ের আলমারিতে এক-একটি চাবি লােগাইয়া দেখিতে লাগিল। আশা আর থাকিতে পারিল না, মদুস্বরে কহিল, “ও-আলমারির চাবি আমার কাছে ছিল না।” কাহার কাছে চাবি ছিল সে কথা আশার মুখ দিয়া বাহির হইল না, কিন্তু মহেন্দ্ৰ তাহা বুঝিল । আশা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, ভয় হইল, পাছে মহেন্দ্রের কাছে আর তাহার কান্না চাপা না থাকে। অন্ধকারে ছাদের প্রাচীবের এক কোণে মুখ ফিরাইয়া দাড়াইয়া উচ্ছসিতা (রোদনকে প্ৰাণপণে রুদ্ধ কবিয়া সে কাদিতে লাগিল । কিন্তু অধিকক্ষণ কান্দিবার সময় ছিল না ! হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, মহেন্দ্রের আহারের সময় হইয়াছে। দ্রুত পদে আশা নীচে চলিয়া গেল । রাজলক্ষ্মী আশাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহিন কোথায়, বউমা ।” আশা কহিল, “তিনি উপরে।” রাজলক্ষ্মী। তুমি নামিয়া আসিলে যে । আশা নতমুখে কহিল, “তাহার খাবার—” রাজলক্ষ্মী। খাবারের আমি ব্যবস্থা করিতেছি, বউমা, তুমি একটু পরিষ্কার হইয়া লও। তোমার সেই নূতন ঢাকাই শাড়িখানা শীঘ্র পরিয়া আমার কাছে এসো, আমি তোমার চুল বাধিয়া দিই। শাশুড়ির আদর উপেক্ষা করিতে পারে না, কিন্তু এই সাজসজার প্রস্তাবে আশা মরমে মরিয়া গেল। মৃত্যু ইচ্ছা করিয়া ভীষ্ম যেরূপ স্তব্ধ হইয়া শরবর্ষণ সহ্য করিয়াছিলেন, আশাও সেরূপ রাজলক্ষ্মীর কৃত সমস্ত প্ৰসাধন পরমধৈর্যে সর্বাঙ্গে গ্রহণ করিল। সাজ করিয়া আশা অতি ধীরে ধীরে নিঃশব্দপদে সিডি বাহিয়া উপরে উঠিল। উকি দিয়া দেখিল, মহেন্দ্ৰ ছাদে নাই। আস্তে আস্তে দ্বারের কাছে আসিয়া দেখিল, মহেন্দ্র ঘরেও নাই, তাহার খাবার অভুক্ত পডিয়া আছে। চাবির অভাবে কাপড়ের আলমারি জোর করিয়া খুলিয়া আবশ্যক কয়েকখন কাপড ও ডাক্তারি