পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 896ł বিহারী যে একেবারেই তাহার চিঠির কোনো উত্তর দিবে না, এ কথা বিনোদিনী কোনোমতেই স্বীকার করিল না- সে বলিল, “আমি সাতটা দিন ধৈর্য ধরিয়া উত্তরের জন্য অপেক্ষা করিব, তাহার পরে দেখা যাইবে।” এই বলিয়া বিনোদিনী অন্ধকারে জানােলা খুলিয়া গ্যাসালোকদীপ্ত কলিকাতার দিকে অন্যমনে চাহিয়া রহিল। এই সন্ধ্যাবেলায় বিহারী এই শহরের মধ্যেই আছে — ইহারই গোটকতক রাস্তা ও গলি পার হইয়া গেলেই এখনই তাহার দরজার কাছে পৌছানো যাইতে পারে- তাহার পরে সেই জলের কলওয়ালা ছোটাে আঙিনা, সেই সিঁড়ি, সেই সুসজ্জিত পরিপাটি আলোকিত নিভৃত ঘরটি— সেখানে নিস্তব্ধ শান্তির মধ্যে বিহারী একলা কেদারায় বসিয়া আছে— হয়তো কাছে সেই ব্ৰাহ্মণ-বালক, সেই সুগোল সুন্দর গৌরবর্ণ আয়তনেত্র সরলমূর্তি ছেলেটি নিজের মনে ছবির বই লইয়া পাতা উলটাইতেছে—একে একে সমস্ত চিত্রটা মনে করিয়া স্নেহে প্রেমে বিনােদিনীর সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ পুলকিত হইয়া উঠিল। ইচ্ছা করিলে এখনই যাওয়া যায়, ইহাই মনে করিয়া বিনোদিনী ইচ্ছাকে বক্ষে তুলিয়া লইয়া খেলা করিতে লাগিল। আগে হইলে হয়তো সেই ইচ্ছা পূৰ্ণ করিতে সে অগ্রসর হইত ; কিন্তু এখন অনেক কথা ভাবিতে হয়। এখন শুধু বাসনা চরিতার্থ করা নয়, উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিতে হইবে। বিনোদিনী কহিল, ‘আগে দেখি বিহারী কিরূপ উত্তর দেয়, তাহার পরে কোন পথে চলা আবশ্যক, স্থির করা যাইবে।” কিছু না বুঝিয়া বিহারীকে বিরক্ত করিতে যাইতে তাহার আর সাহসী হইল ୪୩ । এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে যখন রাত্রি নয়টা-দশটা বাজিয়া গেল, তখন মহেন্দ্ৰ ধীরে ধীরে আসিয়া উপস্থিত। কয়দিন অনিদ্রায় অনিয়মে অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় সে কাটাইয়াছে ; আজি কৃতকার্য হইয়া বিনোদিনীকে বাসায় আনিয়া একেবারে অবসাদ ও শ্রান্তিতে তাহাকে যেন অভিভূত করিয়া দিয়াছে। আজ আর সংসারের সঙ্গে নিজের অবস্থার সঙ্গে লড়াই করিবার বল যেন তাহার নাই। তাহার সমস্ত ভারাক্রান্ত ভাবী জীবনের ক্লান্তি যেন তাহাকে আজ আগে হইতে আক্রমণ করিল। রুদ্ধ দ্বারের কাছে দাডাইয়া ঘা দিতে মহেন্দ্রের অত্যন্ত লজাবোধ হইতে লাগিল । যে উন্মত্ততায় সমস্ত পৃথিবীকে সে লক্ষ করে নাই, সে মত্ততা কোথায়। পথের অপরিচিত লোকদের দৃষ্টির সম্মুখেও তাহার সর্বাঙ্গ সংকুচিত হইতেছে কেন। ভিতরে নূতন চাকরিটা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে— দরজা খোলাইতে অনেক হাঙ্গাম করিতে হইল। অপরিচিত নািতন বাসার অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মহেন্দ্রের মন দমিয়া গেল। মাতার আদরের ধন মহেন্দ্র চিরদিন যে বিলাস-উপকরণে, যে-সকল টানাপাখা ও মূল্যবান চৌকি-সোফায়া অভ্যস্ত, বাসার নূতন আয়োজনে তাহার অভাব সেই সন্ধ্যাবেলায় অত্যন্ত পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। এই-সমস্ত আয়োজন মহেন্দ্রকে সম্পূৰ্ণ করিতে হইবে, বাসার সমস্ত ব্যবস্থার ভার তাঁহারই উপরে। মহেন্দ্র কখনো নিজের বা পরের আরামের জন্য চিন্তা করে নাই— আজি হইতে একটি নূতন গঠিত অসম্পূর্ণ সংসারের সমস্ত খুঁটিনাটি তাহাকেই বহন করিতে হইবে। সিঁড়িতে একটা কেরোসিনের ডিবা অপর্যাপ্ত ধূমোদাগার করিয়া মিটমিট করিতেছিল— তাহার পরিবর্তে একটা ভালো ল্যাম্প কিনিতে হইবে। বারান্দা বাহিয়া সিডিতে উঠিবাব রাস্তাটা কলের জলের প্রবাহে স্যাতস্যাত করিতেছে— মিস্ত্রি ডাকাইয়া বিলাতি মাটির দ্বারা সে জায়গা মেরামত করা আবশ্যক। রাস্তার দিকের দুটো ঘর যে জুতার দোকানদারদের হাতে ছিল, তাহারা সে দুটো ঘর এখনো ছাড়ে নাই, তাহা লইয়া বাড়িওয়ালার সহিত লড়াই করিতে হইবে। এই-সমস্ত কাজ তাহার নিজে না করিলে নয়, ইহাই চকিতের মধ্যে মনে উদয় হইয়া তাহার শ্রান্তির বোঝায় আরো বোঝা চাপিল । মহেন্দ্ৰ সিড়ির কাছে কিছুক্ষণ দাড়াইয়া নিজেকে সামলাইয়া লইল— বিনোদিনীর প্রতি তাহার যে প্রেম ছিল, তাহাকে উত্তেজিত করিল। নিজেকে বুঝাইল যে, এতদিন সমস্ত পৃথিবীকে ভুলিয়া সে যাহাকে চাহিয়াছিল, আজ তাহাকে পাইয়াছে আজ উভয়ের মাঝখানে কোনো বাধা নাই— আজি মহেন্দ্রের আনন্দের দিন । কিন্তু কোনো বাধা যে নাই, তাহাই সর্বাপেক্ষা বড়ো বাধা, আজ মহেন্দ্ৰ