পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S br S চোখের বালি উপরে যাইতেছি।” মা ভাবিলেন মহেন্দ্ৰ বুঝি শয়নগৃহে বিরলে বধূর সঙ্গে কথাবার্তা কহিতে চায়। অত্যন্ত খুশি হইয়া তাড়াতাডি বন্ধনশালায় নিজে গিয়া আশাকে কহিলেন, “যাও, যাও, তুমি একবার শীঘ্ৰ উপরে যাও, আশা দূরুদুরু বক্ষে সসংকোচ পদক্ষেপে উপরে গেল। শাশুড়ির কথায় সে মনে করিয়াছিল, মহেন্দ্ৰ বুঝি তাহাকে ডাকিয়াছে। কিন্তু ঘরের মধ্যে কোনােমতেই হঠাৎ ঢুকিতে পারিল না, ঢুকিবার পৰে আশা অন্ধকারে দ্বারের অন্তরালে মহেন্দ্ৰকে দেখিতে লাগিল। মহেন্দ্র তখন অত্যন্ত শুনাহািদয়ে নীচের বিছানায় পডিয়া তাকিয়ায় ঠেস দিয়া কড়িকাঠ। পযালোচনা করিতেছিল। এই তো সেই মহেন্দ্ৰ— সেই সবই, কিন্তু কী পরিবর্তন। এই ক্ষুদ্র শয়নঘরটিকে একদিন মহেন্দ্র স্বৰ্গ কবিয়া তুলিয়াছিল— আজ কেন সেই আনন্দ স্মৃতিতে-পবিত্র ঘৰটিকে মহেন্দ্ৰ অপমান করিতেছে ; এত কষ্ট, এত বিরক্তি, এত চাঞ্চলা যদি, তবে ও-শয্যায় আর বসিয়ে না, মহেন্দ্র। এখানে আসিয়াও যদি মনে না পড়ে সেই-সমস্ত পরিপূর্ণ গভীর রাত্রি, সেই-সমস্ত সুনিবিড় মধ্যাহ্ন, আত্মহারা কমবিস্মৃত ঘনবর্ষার দিন, দক্ষিণবায়ুকম্পিত বসন্তের বিহবল সন্ধা, সেই অনন্ত অসীম অসংখ্য অনির্বচনীয় কথাগুলি, তবে এ বাড়িতে অনা অনেক ঘর আছে, কিন্তু এই ক্ষুদ্র ব্রিটিতে আর এক মূহুৰ্তও নহে। আশা অন্ধকারে দাড়াইয়া যতই মহেন্দ্ৰকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিল ততই তাহার মনে হইতে লাগিল মহেন্দ্ৰ এইমাত্ৰ সেই বিনোদিনীর কােছ হইতে আসিতেছে ; তাহার অঙ্গে সেই বিনোদিনীর স্পর্শ, তাহার চােখে সেই বিনোদিনীর মর্তি, কানে সেই বিনোদিনীর কণ্ঠস্বর, মনে সেই বিনোদিনীর বাসনা একেবারে লিপ্ত জডিত হইয়া আছে। এই মহেন্দ্ৰকে আশা কেমন করিয়া পবিত্ৰ ভক্তি দিবে, কেমন করিয়া একাগ্রামনে বলিবে, ‘এসো, আমার অনন্যপরায়ণ হৃদয়ের মধ্যে এসো, আমার আটলানিষ্ঠ সতী প্রেমের শুভ্ৰ শতদলের উপর তোমার চরণ-দুখানি রাখো।' সে তাহার মাসির উপদেশ, পুরাণের কথা, শাস্ত্রের অনুশাসন কিছুই মানিতে পারিল না— এই দাম্পত্যস্বৰ্গচু্যত মহেন্দ্ৰকে সে আর মনের মধ্যে দেবতা বলিয়া অনুভব করিল না । সে আজ বিনোদিনীর কলঙ্কপারাবারের মধ্যে তাহার হৃদয়দেবতাকে বিসর্জন দিল ; সেই প্রেমশূন্য রাত্রির অন্ধকারে তাহার কানের মধ্যে, বুকের মধ্যে, মস্তিষ্কের মধ্যে, তাহার সর্বাঙ্গে রক্তস্রোতের মধ্যে, তাহার চারি দিকের সমস্ত সংসারে, তাহার আকাশের নক্ষত্রে, তাহার প্রাচীরবেষ্টিত নিভৃত ছাদটিতে, তাহার শয়নগৃহের পরিত্যক্ত বিরহশয্যাতলে একটি ভয়ানক গম্ভীর বাকুলতার সঙ্গে বিসর্জনের বাদ্য বাজিতে লাগিল। বিনোদিনীর মহেন্দ্ৰ যেন আশার পক্ষে পরপুরুষ, যেন পরপুরুষেরও অধিক—— এমন লজার বিষয় যেন অতি-বড়ো অপরিচিতও নহে। সে কোনোমতেই ঘরে প্রবেশ করিতে পারিল না। একসময় কড়িকাঠ হইতে মহেন্দ্রের অন্যমনস্ক দৃষ্টি সম্মুখের দেয়ালের দিকে নামিয়া আসিল । তাহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া আশা দেখিল, সম্মুখের দেয়ালে মহেন্দ্রের ছবির পাশ্বেই আশার একখানি ফোটােগ্রাফ ঝুলানো রহিয়াছে। ইচ্ছা হইল, সেখানা আঁচল দিয়া ঝাপিয়া ফেলে, টানিয়া ছিড়িয়া লইয়া আসে । অভ্যাসবশত কেন যে সেটা চোখে পড়ে নাই, কেন সে যে এতদিন সেটা নামাইয়া ফেলিয়া দেয় নাই, তাহাই মনে করিয়া সে আপনাকে ধিককার দিতে লাগিল। তাহার মনে হইল, যেন মহেন্দ্ৰ মনে মনে হাসিতেছে এবং তাহার হৃদয়ের আসনে যে বিনোদিনীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত, সে-ও যেন তাহার জোড়া-ভুরুর ভিতর হইতে ঐ ফোটােগ্রাফটার প্রতি সহাস্য কটাক্ষপাত করিতেছে। অবশেষে বিরক্তিপীড়িত মহেন্দ্রের দৃষ্টি দেয়াল হইতে নামিয়া আসিল। আশা আপনার মুখতা ঘুচাইবার জন্য আজকাল সন্ধ্যার সময় কাজকর্ম ও শাশুড়ির সেবা হইতে অবকাশ পাইলেই অনেক রাত্রি পর্যন্ত নির্জনে অধ্যয়ন করিত। তাহার সেই অধ্যয়নের খাতাপত্ৰবইগুলি ঘরের একাধারে গোছানো ছিল। হঠাৎ মহেন্দ্ৰ অলসভাবে তাহার একখানা খাতা টানিয়া লইয়া খুলিয়া দেখিতে লাগিল। আশার ইচ্ছা করিল, চীৎকার করিয়া ছুটিয়া সেখানা কড়িয়া লইয়া আসে। তাহার কঁচা . : S