পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 br○ আবার সে বিদায় লইতে আসিয়াছে। কহিলেন, “মহিন, এখনো ঘুমাস নাই ?” মহেন্দ্ৰ কহিল, “মা, তোমার সেই হাঁপানি কি বাড়িয়াছে।” এতদিন পরে এই প্রশ্ন শুনিয়া মার মনে বড়ো অভিমান জন্মিল। বুঝিলেন, বউ গিয়া বলতেই তাজ মহিন মার খবর লইতে আসিয়াছে। এই অভিমানের আবেগে তাহার বক্ষ আরো আন্দোলিত হইয়া উঠিল— কষ্টে বাক্য উচ্চারণ করিয়া বলিলেন, “যা, তুই শুতে যা। আমার ও কিছুই না।” মহেন্দ্ৰ। না মা, একবার পরীক্ষা করিয়া দেখা ভালো, এ ব্যামো উপেক্ষা করিবার জিনিস নহে। মহেন্দ্ৰ জানিত, তাহার মাতার হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতা আছে, এই কারণে এবং মাতার মুখশ্ৰীীর লক্ষণ দেখিয়া সে উদবেগ অনুভব করিল। মা কহিলেন, “পরীক্ষা করিবার দরকার নাই, আমার এ ব্যামো সারিবার নাহে।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “আচ্ছা, আজ রাত্রের মতো একটা ঘুমের ওষুধ আনাইয়া দিতেছি, কাল ভালো করিয়া দেখা যাইবে।” রাজলক্ষ্মী। ঢের ওষুধ খাইয়াছি, ওষুধে আমার কিছু হয় না। যাও মহিন, অনেক রাত হইয়াছে, তুমি ঘুমাইতে যাও । মহেন্দ্র। তুমি একটু সুস্থ হইলেই আমি যাইব । তখন অভিমানিনী রাজলক্ষ্মী দ্বারের অন্তরালবর্তিনী বধূকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “বউ, কেন তুমি এই রাত্ৰে মহেন্দ্ৰকে বিরক্ত করিবার জন্য এখানে আনিয়াছ।” বলিতে বলিতে তাহার শ্বাসকষ্ট তখন আশা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে মহেন্দ্ৰকে কহিল, “যাও, তুমি শুইতে যাও, আমি মার কাছে থাকিব ।” মহেন্দ্ৰ আশাকে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া কহিল, “আমি একটা ওষুধ আনাইতে পাঠাইলাম। শিশিতে দুই দাগ থাকিবে— এক দাগ খাওয়াইয়া যদি ঘুম না আসে। তবে এক ঘণ্টা পরে আর-এক দাগ খাওয়াইয়া দিয়ে। রাত্রে বাডিলে আমাকে খবর দিতে ভুলিয়ে না।” এই বলিয়া মহেন্দ্র নিজের ঘরে ফিরিয়া গেল। আশা আজ তাহার কাছে যে-মূর্তিতে দেখা দিল, এ যেন মহেন্দ্রের পক্ষে নূতন । এ আশার মধ্যে সংকোচ নাই, দীনতা নাই, এই আশা নিজের অধিকাবের মধ্যে নিজে অধিষ্ঠিত, সেটুকুর জন্য মহেন্দ্রের নিকট সে ভিক্ষাপ্রাথিনী নহে। নিজের স্ত্রীকে মহেন্দ্ৰ উপেক্ষা করিয়াছে, কিন্তু বাড়ির বধূর প্রতি তাহার সম্রাম জন্মিল। আশা তাহার প্রতি যত্নবশত মহেন্দ্ৰকে ডাকিয়া আনিয়াছে, ইহাতে রাজলক্ষ্মী মনে মনে খুশি হইলেন। মুখে বলিলেন, “বউমা, তোমাকে শুতে পাঠাইলাম, তুমি আবার মহেন্দ্রকে টানিয়া আনিলে কেন; }' আশা তাহার উত্তর না দিয়া পাখা-হাতে তাহার পশ্চাতে বসিয়া বাতাস করিতে লাগিল । রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “যাও বউমা, শুতে যাও ।” আশা মৃদুস্বরে কহিল, “আমাকে এইখানে বসিতে বলিয়া গেছেন।” আশা জানিত, মহেন্দ্ৰ মাতার সেবায় তাহাকে নিয়োগ করিয়া গেছে, এ খবরে রাজলক্ষ্মী খুশি হইবেন। 88 রাজলক্ষ্মা যখন স্পষ্টই দেখিলেন, আশা মহেন্দ্রের মন বাধিতে পারিতেছে না, তখন তাহার মনে হইল, ‘অন্তত আমার ব্যামো উপলক্ষ করিয়াও যদি মহেন্দ্ৰকে থাকিতে হয় সেও ভালো ।” তঁহার ভয় হইতে লাগিল, পাছে তাহার অসুখ একেবারে সারিয়া যায় । আশাকে ভাড়াইয়া ওষুধ তিনি অন্যমনস্ক মহেন্দ্ৰ বড়ো-একটা খেয়াল করিত না। কিন্তু আশা দেখিতে পাইত রাজলক্ষ্মীর রোগ