পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8brど k রবীন্দ্র-রচনাবলী কিছুই কমিতেছে না, বরঞ্চ যেন বাড়িতেছে। আশা ভাবিত, মহেন্দ্ৰ যথেষ্ট যত্ন ও চিন্তা করিয়া ঔষধ নির্বাচন করিতেছে না— মহেন্দ্রের মন এতই উদভ্ৰান্ত যে, মাতার পীড়াও তাঁহাকে চেতাইয়া তুলিতে পারিতেছে না। মহেন্দ্রের এতবড়ো দুৰ্গতিতে আশা তাহাকে মনে মনে ধিককার না দিয়া থাকিতে পারিল না। এক দিকে নষ্ট হইলে মানুষ কি সকল দিকেই এমনি করিয়া নষ্ট হয়। একদিন সন্ধ্যাকালে রোগের কষ্টের সময় রাজলক্ষ্মীর বিহারীকে মনে পডিয়া গেল। কতদিন বিহারী আসে নাই, তাহার ঠিক নাই। আশাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বউমা, বিহারী এখন কোথায় আছে জান ?” আশা বুঝিতে পারিল, চিরকাল রোগতাপের সময় বিহারীই মার সেবা করিয়া আসিয়াছে। তাই কষ্টের সময় বিহারীকেই মাতার মনে পড়িতেছে। হায়, এই সংসারের অটল নির্ভর সেই চিরকালের বিহারীও দূর হইল। বিহারী-ঠাকুরপো থাকিলে এই দুঃসময়ে মার যত্ন হইত— ইহার মতো তিনি হৃদয়হীন নহেন। আশার হৃদয় হইতে দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল । রাজলক্ষ্মী। বিহারীর সঙ্গে মহিন বুঝি ঝগড়া করিয়াছে ? বড়ো অন্যায় করিয়াছে বউমা। তাহার মতো এমন হিতাকাঙক্ষী বন্ধু মহিনের আর কেহ নাই। বলিতে বলিতে তাহার দুই চক্ষুর কোণে অশ্রািজল জড়ো হইল। একে একে আশার অনেক কথা মনে পড়িল। অন্ধ মূঢ় আশাকে যথাসময়ে সতর্ক করিবার জন্য বিহারী কতরূপে কত চেষ্টা করিয়াছে এবং সেই চেষ্টার ফলে সে ক্রমশই আশার অপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছে, সেই কথা মনে করিয়া আজি আশা মনে মনে নিজেকে তীব্রভাবে অপমান করিতে লাগিল । একমাত্ৰ সুহৃৎকে লাঞ্ছিত করিয়া একমাত্র শক্ৰকে যে বক্ষে টানিয়া লয়, বিধাতা সেই কৃতঘ্ন মুখকে কেন না। শাস্তি দিবেন। ভগ্নহৃদয় বিহারী যে-নিশ্বাস ফেলিয়া এ ঘর হইতে বিদায় হইয়া গেছে, সে-নিশ্বাস কি এ ঘরকে লাগিবে না। আবার অনেকক্ষণ চিন্তিতমুখে স্থির থাকিয়া রাজলক্ষ্মী হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, “বউমা, বিহারী যদি থাকিত, তবে এই দুর্দিনে সে আমাদের রক্ষা করিতে পারিত— এতদূর পর্যন্ত গড়াইতে পাইত না।” আশা নিস্তব্ধ হইয়া ভাবিতে লাগিল। রাজলক্ষ্মী নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “ সে যদি খবর পায় আমার ব্যামো হইয়াছে, তবে সে না আসিয়া থাকিতে পরিবে না।” আশা বুঝিল, রাজলক্ষ্মীর ইচ্ছা বিহারী এই খবরটা পায়। বিহারীর অভাবে তিনি আজকাল একেবারে নিরাশ্রয় হইয়া পড়িয়াছেন। ঘরের আলো নিবাইয়া দিয়া মহেন্দ্ৰ জ্যোৎস্নায় জানলার কাছে চুপ করিয়া দাড়াইয়া ছিল। পড়িতে আর ভালো লাগে না। গৃহে কোনো সুখ নাই। যাহারা পরমাত্মীয়, তাহাদের সঙ্গে সহজভাবের সম্বন্ধ দূর হইয়া গেলে, তাহাদিগকে পরের মতো অনায়াসে ফেলিয়া দেওয়া যায় না, আবার প্রিয়জনের মতো অনায়াসে তাহাদিগকে গ্ৰহণ করা যায় না- তাহাদের সেই অত্যাজ্য আত্মীয়তা অহরহ অসহ্য ভারের মতো বক্ষে চাপিয়া থাকে। মারা সম্মুখে যাইতে মহেন্দ্রের ইচ্ছা হয় না— তিনি হঠাৎ মহেন্দ্ৰকে কাছে আসিতে দেখিলেই এমন একটা শঙ্কিত উদবেগের সহিত তাহার মুখের দিকে চান যে, মহেন্দ্ৰকে তাহা আঘাত করে। আশা কোনো উপলক্ষে কাছে আসিলে তাহার সঙ্গে কথা কহাও কঠিন হয়, চুপ করিয়া থাকাও কষ্টকর হইয়া উঠে। এমন করিয়া দিন আর কাটিতে চাহে না। মহেন্দ্ৰ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, অন্তত সাত দিন সে বিনোদিনীর সঙ্গে একেবারেই দেখা করিবে না। আরো দুই দিন বাকি আছে- কেমন করিয়া সে দুই দিন কাটিবে। মহেন্দ্ৰ পশ্চাতে পদশব্দ শুনিল। বুঝিল, আশা ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। যেন শুনিতে পায় নাই, এই ভান করিয়া স্থির হইয়া দাড়াইয়া রহিল। আশা সে ভানটুকু বুঝিতে পারিল, তবু ঘর হইতে চলিয়া গেল না। পশ্চাতে দাড়াইয়া কহিল, “একটা কথা আছে, সেইটে বলিয়াই আমি যাইতেছি।” মহেন্দ্ৰ ফিরিয়া কহিল, “যাইতে হইবে কেন, একটু বোসোই-না।” আশা এই ভদ্রতাটুকুতে কান না দিয়া স্থির দাড়াইয়া কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপোকে মারি অসুখের খবর দেওয়া উচিত।”