পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8brbr রবীন্দ্র-রচনাবলী শুনিয়া মহেন্দ্রের মন আশঙ্কায় পূর্ণ হইয়া গেল। সে অনুপস্থিত ছিল, ইতিমধ্যে বিনোদিনী ও বিহারীতে যে দেখা হইয়াছে, ইহাতে তাহার মনে কোনো সংশয় রহিল না। সে কল্পনাচক্ষে দেখিল, বিনোদিনীর বাসার সম্মুখেও এতক্ষণে গোরুর গাড়ি বোঝাই। হইতেছে। তাহার নিশ্চয় বোধ হইল। “এইজন্যই নির্বোিধ আমাকে বিনোদিনী বাসা হইতে দূরে রাখিয়াছিল।” যথেষ্ট দ্রুত চলিতেছে না বলিয়া মহেন্দ্ৰ মাঝে মাঝে কোচম্যানকে গালি দিল । গলির মধ্যে সেই বাসার দ্বারের সম্মুখে পৌঁছিয়া দেখিল, সেখানে যাত্রার কোনো আয়োজন নাই। ভয় হইল, পাছে সে-কার্য পূর্বেই সমাধা হইয়া থাকে। বেগে দ্বারে আঘাত করিল। ভিতর হইতে বৃদ্ধ চাকর দরজা খুলিয়া দিবামাত্ৰ মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “সব খবর ভালো তো ?” সে কহিল, “আজ্ঞা হা, ভালো বৈকি।” মহেন্দ্ৰ উপরে গিয়া দেখিল, বিনোদিনী সুমানে গিয়াছে। তাহার নির্জন শয়নঘরে প্রবেশ করিয়া মহেন্দ্ৰ বিনোদিনীর গতরাত্রে ব্যবহৃত শয্যার উপর লুটাইয়া পড়িল— সেই কোমল আস্তরণকে দুই প্রসারিত হস্তে বক্ষের কাছে আকর্ষণ করিল এবং তাহাকে স্ত্ৰণ করিয়া তাহার উপরে মুখ রাখিয়া বলিতে লাগিল, “নিষ্ঠুর ! নিষ্ঠুর !” এইরূপে হৃদয়োচ্ছাস উন্মুক্ত করিয়া দিয়া শয্যা হইতে উঠিয়া মহেন্দ্ৰ অধীরভাবে বিনোদিনীর প্ৰতীক্ষা করিতে লাগিল। ঘরের মধ্যে পায়চারি করিতে করিতে দেখিল, একখানা বাংলা খবরের কাগজ নীচের বিছানায় খোলা পড়িয়া আছে। সময় কাটাইবার জন্য কতকটা অন্যমনস্কভাবে সেখানা তুলিয়া লইল, যেখানে চোেখ পড়িল, মহেন্দ্ৰ সেইখানেই বিহারীর নাম দেখিতে পাইল। এক মুহুর্তে তাহার সমস্ত মন খবরের কাগজের সেই জায়গাটাতেই কুঁকিয়া পড়িল । একজন পত্রপ্রেরক লিখিতেছে, অল্প বেতনের দরিদ্র কেরানিগণ রুগণ হইয়া পড়িলে তাহাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও সেবার জন্য বিহারী বালিতে গঙ্গার ধারে একটি বাগান লইয়াছেন— সেখানে এক কালে পাচজনকে বিনোদিনী এই খবরটা পডিয়াছে। পড়িয়া তাহার কিরূপ ভাব হইল। নিশ্চয় তাহার মনটা সেইদিকে পালাই-পালাই করিতেছে। শুধু সেজন্য নহে, মহেন্দ্রের মন এই কারণে আরো ছটফট করিতে লাগিল যে, বিহারীর এই সংকল্পে তাহার প্রতি বিনোদিনীর ভক্তি আরো বাডিয়া উঠিবে। বিহারীকে মহেন্দ্ৰ মনে মনে ‘হাম্বাগ’ বলিল, বিহারীর এই কাজটাকে ‘হুজুগ বলিয়া অভিহিত করিল-- কহিল, “ লোকের হিতকারী হইয়া উঠিবার হুজুগ বিহারীর ছেলেবেলা হইতেই আছে।” মহেন্দ্ৰ নিজেকে বিহারীর তুলনায় একান্ত অকপট অকৃত্ৰিম বলিয়া বাহবা দিবার চেষ্টা করিল— কহিল, ‘ঔদাযি ও আত্মত্যাগের ভড়ঙে মূঢ়লোক ভুলাইবার চেষ্টাকে আমি ঘূণা করি।” কিন্তু হায়, এই পরমনিশ্চেষ্ট অকৃত্রিমতার মাহাত্ম্য লোকে অর্থাৎ বিশেষ কোনো-একটি লোক হয়তো বুঝিবে না। মহেন্দ্রের মনে হইতে লাগিল, বিহারী যেন তাহার উপরে এও একটা চাল চালিয়াছে। বিনোদিনীর পদশব্দ শুনিয়া মহেন্দ্ৰ তাড়াতাড়ি কাগজখানা মুড়িয়া তাহার উপরে চাপিয়া বসিল । স্নাত বিনোদিনী ঘরে প্রবেশ করিলে, মহেন্দ্ৰ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বিস্মিত হইয়া উঠিল। তাহার কী—এক অপরূপ পরিবর্তন হইয়াছে। সে যেন এই কয়দিন আগুন জ্বালিয়া তপস্যা করিতেছিল। তাহার শরীর কৃশ হইয়া গেছে, এবং সেই কৃশতা ভেদ করিয়া তাহার পাণ্ডুবৰ্ণ মুখে একটি দীপ্তি বাহির হইতেছে। করিয়া সে অহােরাত্রি নিঃশব্দে দগ্ধ হইতেছিল। এই দাহ হইতে নিষ্কৃতি পাইবার কোনো পথ তাহার কাছে ছিল না। বিহারী যেন তাহাকেই তিরস্কার করিয়া পশ্চিমে চলিয়া গেছে- তাহার নাগাল পাইবার কোনো উপায় বিনোদিনীর হাতে নাই। কর্মপরায়ণা নিরলসা বিনোদিনী কর্মের অভাবে এই ক্ষুদ্র বাসার মধ্যে যেন রুদ্ধশ্বাস হইয়া উঠিতেছিল— তাহার সমস্ত উদ্যম তাহার নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া আঘাত করিতেছিল। তাহার সমস্ত ভাবী জীবনকে এই প্ৰেমহীন কর্মহীন আনন্দহীন বাসার মধ্যে, এই