পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8br> কদ্ধ গলির মধ্যে চিরকালের জন্য আবদ্ধ কল্পনা করিয়া তাহার বিদ্রোহী প্রকৃতি আয়ত্তাতীত অদৃষ্টের বিরুদ্ধে যেন আকাশে মাথা ঠুকিবার ব্যর্থ চেষ্টা করিতেছিল। যে মূঢ় মহেন্দ্র বিনোদিনীর সমস্ত মুক্তির পথ চারি দিক হইতে রুদ্ধ করিয়া তাহার জীবনকে এমন সংকীর্ণ করিয়া তুলিয়াছে, তাহার প্রতি বিনোদিনীর ঘূণা ও বিদ্বেষের সীমা ছিল না। বিনোদিনী বুঝিতে পারিয়াছিল, সেই মহেন্দ্ৰকে সে কিছুতেই আর দূরে ঠেলিয়া রাখিতে পরিবে না। এই ক্ষুদ্র বাসায় মহেন্দ্র তাহার কাছে ঘেষিয়া সম্মুখে আসিয়া বসিবে- প্ৰতিদিন অলক্ষ্য আকর্ষণে তিলে তিলে তাহার দিকে অধিকতর অগ্রসর হইতে থাকিবে- এই অন্ধকূপে, এই সমাজভ্ৰষ্ট জীবনের পঙ্কশয্যায়। ঘূণা এবং আসক্তির মধ্যে যে প্রাতাহিক লড়াই হইতে থাকিবে, তাহা অত্যন্ত বীভৎস। বিনোদিনী স্বহস্তে স্বচেষ্টায় মাটি খুঁডিয়া মহেন্দ্রের হৃদয়ের অন্তস্তল হইতে এই যে একটা লোলজিহবা লোলুপতার ক্লেদাক্ত সরীসৃপকে বাহির করিয়াছে, ইহাব পুচ্ছপাশ হইতে সে নিজেকে কেমন করিয়া রক্ষা করিবে। একে বিনোদিনীর ব্যথিত হৃদয়, ৩াহাতে এই ক্ষুদ্র অবরুদ্ধ বাসা, তাহাতে মহেন্দ্রের বাসনা-তরঙ্গের অহরহ অভিঘাত— ইহা কল্পনা করিয়াও বিনোদিনীর সমস্ত চিত্ত আতঙ্কে পীড়িত হইয়া উঠে। জীবনে ইহার সমাপ্তি কোথায় । কবে সে এই সমস্ত হইতে বাহির হইতে পরিবে । বিনোদিনীর সেই কৃশপাণ্ডুর মুখ দেখিয়া মহেন্দ্রের মনে ঈর্ষানল জ্বলিয়া উঠিল। তাহার কি এমন কোনো শক্তি নাই, যাহা দ্বারা সে বিহারীর চিন্তা হইতে এই তপস্বিনীকে বলপর্বক উৎপাটিত করিয়া লাইতে পারে। ঈগল যেমন মেষশাবককে এক নিমেষে ছো। মারিয়া তাহার সুদুৰ্গম অভ্ৰভেদী পর্বতনীড়ে উত্তীণ করে, তেমনি এমন কি কোনো মেঘপরিবৃত নিখিলবিস্মৃত স্থান নাই, যেখানে একাকী মহেন্দ্ৰ তাহার এই কোমল—সুন্দর শিকারটিকে আপনার বুকের কাছে লুকাইয়া রাখিতে পারে। ঈর্ষার উত্তাপে তাহার ইচ্ছার আগ্রহ চতুগুণ বাড়িয়া উঠিল। আর কি সে একমুহূর্তও বিনোদিনীকে চোখের আড়াল করিতে পরিবে। বিহারীর বিভীষিকাকে অহরহ ঠেকাইয়া রাখিতে হইবে, তাহাকে সূচ্যগ্ৰমাত্র অবকাশ দিতে আর তো মহেন্দ্রের সাহসী হইবে না। বিরহীতাপে রমণীর সৌন্দর্যকে সুকুমার করিয়া তোলে, মহেন্দ্র এ কথা সংস্কৃত কাবো পড়িয়াছিল, আজ বিনোদিনীকে দেখিয়া সে তাহা যতই অনুভব করিতে লাগিল, ততই সুখমিশ্রিত দুঃখের সুতীব্র আলোডনে তাহার হৃদয় একান্ত মথিত হইয়া উঠিল। বিনোদিনী ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া মহেন্দ্ৰকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কি চা খাইয়া আসিয়ােছ।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “নহয় খাইয়া আসিয়াছি, তাই বলিয়া স্বহস্তে আর-এক পেয়ালা দিতে কৃপণতা করিয়ো না— ‘পালা মুঝ ভর দে রে’।” বিনােদিনী বোধ হয় ইচ্ছা করিয়া নিতান্ত নিষ্ঠুরভাবে মহেন্দ্রের এই উচ্ছাসে হঠাৎ আঘাত দিল— কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো এখন কোথায় আছেন খবর জান ?” মহেন্দ্ৰ নিমেষের মধ্যে বিবৰ্ণ হইয়া কহিল, “ সে তো এখন কলিকাতায় নাই।” বিনোদিনী। তাহার ঠিকানা কী । মহেন্দ্ৰ। সে তো কাহাকেও বলিতে চাহে না । বিনোদিনী । সন্ধান করিয়া কি খবর লওয়া যায় না | মহেন্দ্র। আমার তো তেমন জরুরি দরকার কিছু দেখি না। বিনোদিনী। দরকারই কি সব। আশৈশব বন্ধুত্ব কি কিছুই নয়। মহেন্দ্র। বিহারী আমার আশৈশব বন্ধু বটে, কিন্তু তোমার সঙ্গে তাহার বন্ধুত্ব দুদিনের— তবু তাগিদটা তোমারই যেন অত্যন্ত বেশি বোধ হইতেছে। বিনোদিনী । তাহাই দেখিয়া তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত । বন্ধুত্ব কেমন করিয়া করিতে হয়, তাহা তোমার আমন বন্ধুর কাছ হইতেও শিখিতে পারিলে না ? মহেন্দ্র। সেজন্য তত দুঃখিত নহি, কিন্তু ফাকি দিয়া স্ত্রীলোকের মন হরণ কেমন করিয়া করিতে হয়, সে বিদ্যা তাহার কাছে শিখিলে আজ কাজে লাগিতে পারিত।