পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8为8 রবীন্দ্র-রচনাবলী রাজলক্ষ্মী বা আশার কাছে অন্নপূর্ণা মহেন্দ্রের সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন পাড়িতে সাহস করিলেন না। সাধুচরণকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মামা, মহিন কোথায়।” তখন সাধুচরণ বিনােদিনী ও মহেন্দ্রের সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিয়া বলিলেন। অন্নপূর্ণ সাধুচরণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিহারীর কী খবর।” সাধুচরণ কহিলেন, “অনেক দিন তিনি আসেন নাই— তাহার খবর ঠিক বলিতে পারি না।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “একবার বিহারীর বাড়িতে গিয়া তাহার সংবাদ জানিয়া আইস।” সাধুচরণ ফিরিয়া আসিয়া কহিলেন, “তিনি বাড়িতে নাই, বালিতে গঙ্গার ধারে বাগানে গিয়াছেন।” অন্নপূর্ণা নবীন-ডাক্তারকে ডাকিয়া রোগীর অবস্থা জিজ্ঞাসা করিলেন। ডাক্তার কহিল, “হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতার সঙ্গে উদরী দেখা দিয়াছে, মৃত্যু অকস্মাৎ কখন আসিবে কিছুই বলা যায় না।” সন্ধ্যার সময় রাজলক্ষ্মীর রোগের কষ্ট যখন বাড়িয়া উঠিতে লাগিল, তখন অন্নপূর্ণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি, একবার নবীন-ডাক্তারকে ডাকাই।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “না মেজেবিউ, নবীন-ডাক্তার আমার কিছুই করিতে পরিবে না।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “তবে কাহাকে তুমি ডাকিতে চাও, বলো।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “একবার বিহারীকে যদি খবর দাও তো ভালো হয়।” অন্নপূর্ণার বক্ষের মধ্যে আঘাত লাগিল। সেদিন দূরপ্রবাসে সন্ধ্যাবেলায় তিনি দ্বারের বাহির হইতে অন্ধকারের মধ্যে বিহারীকে অপমানের সহিত বিদায় করিয়া দিয়াছিলেন, সেই বেদনা তিনি আজ পর্যন্ত ভুলিতে পারেন নাই। বিহারী আর কখনোই তাহার দ্বারে ফিরিয়া আসিবে না। ইহজীবনে আর যে কখনো সেই অনাদরের প্রতিকার করিতে অবসর পাইবেন, এ আশা তাহার মনে ছিল না। অন্নপূর্ণ একবার ছাদের উপর মহেন্দ্রের ঘরে গেলেন। বাড়ির মধ্যে এই ঘরটিই ছিল আনন্দনিকেতন। আজ সে ঘরের কোনো শ্ৰী নাই—বিছানাপত্র বিশৃঙ্খল, সাজসজা অনাদৃত, ছাদের টবে কেহ জল দেয় না, গাছগুলি শুকাইয়া গেছে। মাসিম ছাদে গিয়াছেন বুঝিয়া আশাও ধীরে ধীরে তাহার অনুসরণ করিল। অন্নপূর্ণ তাহাকে বক্ষে টানিয়া লইয়া তাহার মস্তকচুম্বন করিলেন। আশা নত হইয়া দুই হাতে তাহার দুই পা ধরিয়া বার বার তাহার পায়ে মাথা ঠেকাইল। কহিল, “মাসিম, আমাকে আশীৰ্বাদ করো, আমাকে বল দাও। মানুষ যে এত কষ্ট সহ্য করিতে পারে, তাহা আমি কোনোকালে ভাবিতেও পারিতাম না। মা গো, এমন আর কতদিন সহিবে।” অন্নপূর্ণা সেইখানেই মাটিতে বসিলেন, আশা তাহার পায়ে মাথা দিয়া লুটাইয়া পড়িল। অন্নপূর্ণ আশার মাথা কোলের উপর তুলিয়া লইলেন, এবং কোনো কথা না কহিয়া নিস্তব্ধভাবে জোড়হাত করিয়া দেবতাকে স্মরণ করিলেন। অন্নপূর্ণার স্নেহসিঞ্চিত নিঃশব্দ আশীর্বাদ আশার গভীর হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিয়া অনেক দিন পরে শান্তি আনয়ন করিল। তাহার মনে হইল, তাহার অভীষ্ট যেন সিদ্ধপ্ৰায় হইয়াছে। দেবতা তাহার মতো মূঢ়কে অবহেলা করিতে পারেন, কিন্তু মাসিমার প্রার্থনা অগ্রাহা করিতে পারেন না। হৃদয়ের মধ্যে আশ্বাস ও বল পাইয়া আশা অনেকক্ষণ পরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া বসিল । কহিল, “মাসিম, বিহারী-ঠাকুরপোকে একবার আসিতে চিঠি লিখিয়া দাও।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “না, চিঠি লেখা হইবে না।” আশা । তবে তাহাকে খবর দিবে কী করিয়া । অন্নপূর্ণ কহিলেন, “কাল আমি বিহারীর সঙ্গে নিজে দেখা করিতে যাইব ।”