পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 ふ と রবীন্দ্র-রচনাবলী ভুলিবে। তাহার দৃষ্টি তাহার আকাঙক্ষা আজ সর্বত্র ব্যাপ্ত হইয়া পডিয়াছে, তাহার ব্যাকুল ঘননিশ্বাস বিহারীর রক্তস্রোতকে অহরহ তরঙ্গিত করিয়া তুলিতেছে এবং তাহার স্পর্শের সুকোমল উত্তাপ কিন্তু তবু সেই বিনোদিনীর কাছ হইতে বিহারী আজ এমন দূরে রহিয়াছে কেন। তাহার কারণ এই বিনোদিনী যে-সৌন্দর্যরসে বিহারীকে অভিষিক্ত করিয়া দিয়াছে, সংসারের মধ্যে বিনোদিনীর সহিত সেই সৌন্দর্যের উপযুক্ত কোনো সম্বন্ধ সে কল্পনা করিতে পারে না। পদ্মকে তুলিতে গেলে পঙ্ক উঠিয়া পড়ে। কী বলিয়া তাহাকে এমন-কোথায় স্থাপন করিতে পারে, যেখানে সুন্দর বীভৎস হইয়া না উঠে। তাহা ছাড়া মহেন্দ্রের সহিত যদি কাড়াকড়ি বাধিয়া যায়, তবে সমস্ত ব্যাপারটা এতই কুৎসিত আকার ধারণ করিবে যে, সে সম্ভাবনা বিহারী মনের প্রান্তেও স্থান দিতে পারে না। তাই বিহারী নিভৃত গঙ্গাতীরে বিশ্বসংগীতের মাঝখানে তাহার মানসী প্রতিমাকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া আপনার হৃদয়কে ধূপের মতো দগ্ধ করিতেছে। পাছে এমন কোনো সংবাদ পায়, যাহাতে তাহার সুখস্বপ্নজাল ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, তাই সে চিঠি লিখিয়া বিনোদিনীর কোনো খবরও লয় না । তাহার বাগানের দক্ষিণ প্রান্তে ফলপূৰ্ণ জামগাছের তলায় মেঘাচ্ছন্ন প্ৰভাতে বিহারী চুপ করিয়া পড়িয়া ছিল, সম্মুখ দিয়া কুঠির পানসি যাতায়াত করিতেছিল, তা-ই সে অলসভাবে দেখিতেছিল ; ক্ৰমে বেলা বাডিয়া যাইতে লাগিল। চাকর আসিয়া, আহারের আয়োজন করিবে কি না জিজ্ঞাসা করিল—— বিহারী কহিল, “এখন থাক।” মিস্ত্রির সর্দার আসিয়া বিশেষ পরামর্শের জন্য তাহাকে কাজ দেখিতে আহবান করিল— বিহারী কহিল, “আর-একটু পরে।” এমন সময় বিহারী হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া দেখিল, সম্মুখে অন্নপূর্ণ। শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া পড়িল— দুই হাতে তাহার পা চাপিয়া ধরিয়া ভূতলে মাথা রাখিয়া প্ৰণাম করিল। অন্নপূর্ণ তাহার দক্ষিণ হস্ত দিয়া পরামমোহে বিহারীর মাথা ও গা স্পর্শ করিলেন। অশ্রুজডিতস্বরে কহিলেন, “বিহারী, তুই এত রোগ হইয়া গেছিস কেন ।” বিহারী কহিল, “কাকীমা, তোমার স্নেহ ফিরিয়া পাইবার জন্য ।” শুনিয়া অন্নপূর্ণার চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। বিহারী বাস্ত হইয়া কহিল, “কাকীমা, তোমার এখনো খাওয়া হয় নাই ?” অন্নপণা কহিলেন, “না, এখনো আমার সময় হয় নাই।” বিহারী কহিল, “চলো, আমি রাধিবার জোগাড় করিয়া দিই গে। আজ অনেক দিন পরে তোমার হাতের রান্না এবং তোমার পাতের প্রসাদ খাইয়া বাচিব ।” মহেন্দ্ৰ-আশার সম্বন্ধে বিহারী কোনো কথাই উত্থাপন করিল না। অন্নপূর্ণা একদিন স্বহস্তে বিহারীর নিকটে সেদিককার দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। অভিমানের সহিত সেই নিষ্ঠুর নিষেধ সে পালন করিল। আহারান্তে অন্নপূর্ণা কহিলেন, “ নৌকা ঘাটেই প্ৰস্তুত আছে, বিহারী, এখন একবার কলিকাতায় চল ।” বিহারী কহিল, “কলিকাতায় আমার কোন প্রয়োজন।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “দিদির বড়ো অসুখ, তিনি তোকে দেখিতে চাহিয়াছেন।” শুনিয়া বিহারী চকিত হইয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিল, “মহিনদা কোথায় ।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “সে কলিকাতায় নাই, পশ্চিমে চলিয়া গেছে।” শুনিয়া মুহুর্তে বিহারীর মুখ বিবৰ্ণ হইয়া গেল। সে চুপ করিয়া রহিল। অন্নপূর্ণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুই কি সকল কথা জানিস নে ৷” বিহারী কহিল, “কতকটা জানি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানি না ।” তখন অন্নপূর্ণ বিনোদিনীকে লইয়া মহেন্দ্রের পশ্চিমে পলায়ন-বার্তা বলিলেন। বিহারীর চক্ষে তৎক্ষণাৎ জলস্থল-আকাশের সমস্ত রঙ বদলাইয়া গেল, তাহার কল্পনা-ভাণ্ডারের সমস্ত সঞ্চিত রস