পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8S মুহুর্তে তিক্ত হইয়া উঠিল। মায়াবিনী বিনােদিনী কি সেদিনকার সন্ধাবেলায় আমাকে লইয়া খেলা করিয়া গেল। তাহার ভালোবাসার আত্মসমপণ সমস্তই ছলনা ! সে তাহার গ্রাম ত্যাগ করিয়া নির্লজ্জভাবে মহেন্দ্রের সঙ্গে একাকিনী পশ্চিমে চলিয়া গেল! ধিক তাহাকে, এবং ধিক আমাকে যে-আমি মূঢ়- তাহাকে এক মুহুর্তের জন্যও বিশ্বাস করিয়াছিলাম।” হায় মেঘাচ্ছন্ন আষাঢ়ের সন্ধ্যা, হায় গতবৃষ্টি পূৰ্ণিমার রাত্ৰি, তোমাদের ইন্দ্ৰজাল কোথায় গেল। 8S বিহারী ভাবিতেছিল, দুঃখিনী আশার মুখের দিকে সে চাহিবে কী করিয়া। দেউড়ির মধ্যে যখন সে প্রবেশ করিল, তখন নাথহীন সমস্ত বাড়িটার ঘনীভূত বিষাদ তাহাকে এক মুহুর্তে আবৃত করিয়া ফেলিল। বাড়ির দরোয়ান ও চাকরীদের মুখের দিকে চাহিয়া উন্মত্ত নিরুদ্দেশ মহেন্দ্রের জন্য লজ্জায় বিহারীর মাথা নত করিয়া দিল। পরিচিত ভৃত্যদিগকে সে স্নিগ্ধভাবে পূর্বের মতো কুশল জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না। অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতে তাহার পা যেন সরিতে চাহিল না। বিশ্বজনের সম্মুখে প্রকাশ্যভাবে মহেন্দ্ৰ অসহায় আশাকে যে দারুণ অপমানের মধ্যে নিক্ষেপ করিয়া গেছে, যে-অপমানে স্ত্রীলোকের চরমতম আবরণটুকু হরণ করিয়া তাহাকে সমস্ত সংসারের সকৌতুহল কৃপাদৃষ্টিবৰ্ষণের মাঝখানে দাড় করাইয়া দেয়, সেই অপমানের অনাবৃত প্ৰকাশ্যতার মধ্যে বিহারী কুষ্ঠিত ব্যথিত আশাকে দেখিবে কোন প্ৰাণে। কিন্তু এ-সকল চিন্তার ও সংকোচের আর অবসর রহিল না। অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতেই আশা দ্রুত পদে আসিয়া বিহারীকে কহিল, “ঠাকুরপো, একবার শীঘ্ৰ আসিয়া মাকে দেখিয়া যাও, তিনি বড়ো কষ্ট পাইতেছেন।” বিহারীর সঙ্গে আশার প্রকাশ্যভাবে এই প্ৰথম আলাপ | দুঃখের দুর্দিনে একটিমাত্ৰ সামান্য ঝটিকায় সমস্ত ব্যবধান উড়াইয়া লইয়া যায়; যাহারা দূরে বাস করিতেছিল তাহাদিগকে হঠাৎ—বন্যায় একটিমাত্র সংকীর্ণ ডাঙার উপরে একত্ৰ করিয়া দেয়। আশার এই সংকোচহীন ব্যাকুলতায় বিহারী আঘাত পাইল। মহেন্দ্ৰ তাহার সংসারটিকে যে কী করিয়া দিয়া গেছে, এই ক্ষুদ্র ঘটনা হইতেই তাহা সে যেন অধিক বুঝিতে পারিল। দুদিনের তাড়নায় ঘুচিয়াছে- ছোটোখাটো আবরণ-অন্তরাল বাছ-বিচার সমস্ত খসিয়া পড়িয়া গেছে- তাহাতে আর ভূক্ষেপ করিবার সময় নাই। বিহারী রাজলক্ষ্মীর ঘরে প্রবেশ করিল। রাজলক্ষ্মী একটা আকস্মিক শ্বাসকষ্ট অনুভব করিয়া বিবৰ্ণ হইয়া উঠিয়াছিলেন- সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী না হওয়াতে পুনর্বার কতকটা সুস্থ হইয়া উঠিয়াছিলেন। বিহারী প্ৰণাম করিয়া তাহার পদধূলি লইতেই রাজলক্ষ্মী তাহাকে পাশে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন, এবং ধীরে ধীরে কহিলেন, “কেমন আছিস বেহারি। কতদিন তোকে দেখি নাই।” বিহারী কহিল, “মা, তোমার অসুখ, এ খবর আমাকে কেন জানাইলে না। তাহা হইলে কি আমি এক মুহুর্ত বিলম্ব করিতাম।” রাজলক্ষ্মী মৃদুস্বরে কহিলেন, “সে কি আর আমি জানি না, বাছা। তোকে পেটে ধরি নাই বটে, কিন্তু জগতে তোর চেয়ে আমার আপনার আর কি কেহ আছে।” বলিতে বলিতে তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। বিহারী তাড়াতাড়ি উঠিয়া ঘরের কুলুঙ্গিতে ওষুধপত্রের শিশি-কোঁটাগুলি পরীক্ষা করিবার ছলে আত্মসংবরণের চেষ্টা করিল। ফিরিয়া আসিয়া সে যখন রাজলক্ষ্মীর নাড়ি দেখিতে উদ্যত হইল, রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার নাড়ির খবর থাক— জিজ্ঞাসা করি, তুই এমন রোগ হইয়া গেছিস কেন, বেহারি।” বলিয়া রাজলক্ষ্মী তাহার কৃশ হস্ত তুলিয়া বিহারীর কণ্ঠায় হাত বুলাইয়া দেখিলেন।