পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ ○○ রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহার পরে হ্রাণমাত্র না করিয়া আজি মাটিতে ফেলিয়া দিতেছে কেন।” বিনোদিনী কহিল, “পশ্চিম দিকে যেখানে খুশি চলো— কাল সকালে যেখানে গাড়ি থামিবে, নামিয়া পড়িব ।” এমনতরো ভ্ৰমণ মহেন্দ্রের কাছে লোভনীয় নহে। আরামের ব্যাঘাত তাহার পক্ষে কষ্টকর। বড়ো শহরে গিয়া ভালোরূপ আশ্রয় না পাইলে মহেন্দ্রের বড়ো মুশকিল। সে খুঁজিয়া-পাতিয়া করিয়া-কর্মিয়া লাইবার লোক নহে। তাই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ-বিরক্ত মনে মহেন্দ্ৰ গাড়িতে উঠিল। এ দিকে মনে কেবলই ভয় হইতে লাগিল, পাছে বিনোদিনী তাহাকে না জানাইয়াই কোথাও নামিয়া পড়ে। বিনোদিনী এইরূপ শনিগ্রহের মতো ঘুরিতে এবং মহেন্দ্রকে ঘুরাইতে লাগিল— কোথাও তাহাকে বিশ্রাম দিল না। বিনোদিনী অতি শীঘ্রই লোককে আপনি করিয়া লইতে পারে ; অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সে গাড়ির সহযাত্ৰিণীদের সহিত বন্ধুত্বস্থাপন করিয়া লইত। যেখানে যাইবার ইচ্ছা, সেখানকার সমস্ত খবর লইত— যাত্রিশালায় আশ্রয় লইত এবং যেখানে যাহা-কিছু দেখিবার আছে, ঘুরিয়া-ঘুরিয়া বন্ধুসহায়ে দেখিয়া লইত। মহেন্দ্ৰ বিনোদিনীর কাছে নিজের অনাবশ্যকতায় প্রতিদিন আপনাকে হতমান বোধ করিতে লাগিল। টিকিট কিনিয়া দেওয়া ছাড়া তাহার কোনো কাজ ছিল না, বাকি সময়টা তাহার প্রবৃত্তি তাহাকে ও সে আপন প্রবৃত্তিকে দংশন করিতে থাকিত। প্ৰথম প্রথম কিছুদিন সে বিনোদিনীর সঙ্গে সঙ্গে পথে পথে ফিরিয়াছিল— কিন্তু ক্রমে তাহা অসহ্য হইয়া উঠিল; তখন মহেন্দ্ৰ মহেন্দ্ৰ যে এমন করিয়া পথে বাহির হইয়া পডিতে পারে, তাহা কেহ কল্পনাও করিতে পারিত না | একদিন এলাহাবাদ স্টেশনে দুই জনে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। কোনো আকস্মিক কারণে ট্রেন আসিতে বিলম্ব হইতেছে। ইতিমধ্যে অন্যান্য গাড়ি যত আসিতেছে ও যাইতেছে, দিকে চাহিয়া দেখিতে দেখিতে সে হঠাৎ কাহারও দেখা পাইবে, এই বোধ করি তাহার আশা । অন্তত, রুদ্ধ গলির মধ্যে জনহীন গৃহে নিশ্চল উদ্যমে নিজেকে প্রত্যহ চাপিয়া মারার চেয়ে এই নিত্যসন্ধানপরতার মধ্যে, এই উন্মুক্ত পথের জনকোলাহলের মধ্যে শান্তি আছে। হঠাৎ এক সময়ে স্টেশনে একটি কাচের বাক্সের উপর রিনোদিনীর দৃষ্টি পড়িতেই সে চমকিয়া উঠিল। এই পোস্ট-আপিসের বাক্সের মধ্যে, যে-সকল লোকের উদ্দেশ পাওয়া যায় নাই তাহদের পত্ৰ প্ৰদৰ্শিত হইয়া থাকে। সেই বাক্সে সজিত একখানি পত্রের উপরে বিনোদিনী বিহারীর নাম দেখিতে পাইল। বিহারীলাল নামটি অসাধারণ নহে— পত্রের বিহারীই যে বিনোদিনীর অভীষ্ট বিহারী, এ কথা মনে করিবার কোনো হেতু ছিল না— তবু বিহাবীর পুরা নাম দেখিয়া সেই একটিমাত্র বিহারী ছাড়া আর-কোনো বিহারীর কথা তাহার মনে সন্দেহ হইল না। পত্রে লিখিত ঠিকানাটি সে মুখস্থ করিয়া লাইল। অত্যন্ত অপ্ৰসন্নমুখে মহেন্দ্র একটা বেঞ্চের উপর বসিয়া ছিল, বিনোদিনী সেখানে আসিয়া কহিল, “কিছুদিন এলাহাবাদেই থাকিব।” বিনোদিনী নিজের ইচ্ছামত মহেন্দ্ৰকে চালাইতেছে, অথচ তাহার ক্ষুধিত অতৃপ্ত হৃদয়কে হইয়া উঠিতেছিল। এলাহাবাদে কিছুদিন থাকিয়া জিরাইতে পাইলে সে বঁাচিয়া যায়— কিন্তু ইচ্ছার অনুকূল হইলেও বিনোদিনীর খেয়ালমাত্রে সম্মতি দিতে তাহার মন হঠাৎ বাকিয়া দাড়াইল। সে রাগ করিয়া কহিল, “যখন বাহির হইয়াছি, তখন যাইবই। ফিরিতে পারিব না।” বিনোদিনী কহিল, “আমি যাইব না।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “তবে তুমি একলা থাকে, আমি চলিলাম।” p