পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(? ○○ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী শয়নঘরে শুষ্ক ফুল এবং ছিন্ন মালা ছড়ানো। তাহার মন নিমেষের মধ্যেই প্রবলবেগে বিমুখ হইয়া গেল। বিহারী যখন দূরে ছিল, তখন বিনোদিনীর জীবনযাত্ৰাসম্বন্ধে কোনো সন্দেহজনক চিত্র যে তাহার মনে উদয় হয় নাই তাহা নহে, কিন্তু কল্পনার লীলা সে চিত্রকে ঢাকিয়াও একটি উজ্জ্বল মোহিনীচ্ছবি দাড় করাইয়াছিল। বিহারী যখন বাগানে প্ৰবেশ করিতেছিল তখন তাহার হৃৎকম্প হইতেছিল— পাছে কল্পনাপ্রতিমায় অকস্মাৎ আঘাত লাগে, এইজন্য তাহার চিত্ত সংকুচিত হইতেছিল। বিহারী বিনোদিনীর শয়নগৃহের দ্বারের সম্মুখে দাড়াইবামাত্র সেই আঘাতটাই লাগিল। দূরে থাকিয়া বিহারী একসময় মনে করিয়াছিল, সে আপনার প্রেমাভিষেকে বিনােদিনীর জীবনের সমস্ত পঙ্কিলতা অনায়াসে ধৌত করিয়া লইতে পরিবে। কাছে আসিয়া দেখিল, তাহা সহজ নহে- মনের মধ্যে করুণার বেদনা আসিল কই। হঠাৎ ঘূণার তরঙ্গ উঠিয়া তাহাকে অভিভূত করিয়া দিল। বিনোদিনীকে বিহারী অত্যন্ত মলিন দেখিল । এক মুহুর্তেই বিহারী ফিরিয়া দাড়াইয়া “মহেন্দ্ৰ” “মহেন্দ্ৰ” করিয়া ডাকিল। এই অপমান পাইয়া বিনোদিনী নম্র মৃদুস্বরে কহিল, “মহেন্দ্ৰ নাই, মহেন্দ্র শহরে গেছে।” বিহারী চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে বিনোদিনী কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, তোমার পায়ে ধরি, একটুখানি তোমাকে বসিতে হইবে।” বিহারী কোনো মিনতি শুনিবে না মনে করিয়াছিল, একেবারে এই ঘূণার দৃশ্য হইতে এখনই নিজেকে দূরে লইয়া যাইবে স্থির করিয়াছিল, কিন্তু বিনোদিনীর করুণ অনুনয়স্বর শুনিবা মাত্র ক্ষণকালের জন্য তাহার পা যেন আর উঠিল না। বিনোদিনী কহিল, “আজ যদি তুমি বিমুখ হইয়া এমন করিয়া চলিয়া যাও, তবে আমি তোমারই শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি মরিব ।” বিহারী তখন ফিরিয়া দাড়াইয়া কহিল, “বিনােদিনী, তোমার জীবনের সঙ্গে আমাকে তুমি জড়াইবার চেষ্টা করিতেছ। কেন । আমি তোমার কী করিয়াছি। আমি তো কখনো তোমার পথে দাড়াই নাই, তোমার সুখদুঃখে হস্তক্ষেপ করি নাই।” বিনোদিনী কহিল, “তুমি আমার কতখানি অধিকার করিয়াছ, তাহা একবার তোমাকে জানাইয়াছি—তুমি বিশ্বাস কর নাই। তবু আজ আবার তোমার বিরাগের মুখে সেই কথাই জানাইতেছি। তুমি তো আমাকে না বলিয়া জানাইবার, লজ্জা করিয়া জানাইবার, সময় দাও নাই। তুমি আমাকে ঠেলিয়া ফেলিয়াছ, তবু আমি তোমার পা ধরিয়া বলিতেছি, আমি তোমাকে-” বিহারী বাধা দিয়া কহিল, “ সে কথা আর বলিয়ে না, মুখে আনিয়ো না। সে কথা বিশ্বাস করিবার (७ों ना |” বিনোদিনী। সে কথা ইতর লোকে বিশ্বাস করিতে পারে না, কিন্তু তুমি করিবে। সেইজন্য একবার আমি তোমাকে বসিতে বলিতেছি। বিহারী । আমি বিশ্বাস করি বা না করি, তাহাতে কী আসে যায়। তোমার জীবন যেমন চলিতেছে, তেমনি চলিবে তো । বিনোদিনী। আমি জানি তোমার ইহাতে কিছুই আসিবে-যাইবে না। আমার ভাগ্য এমন যে, হইতে আমাকে দূরেই থাকিতে হইবে। আমার মন তোমার কাছে এই দাবিটুকু কেবল ছাড়িতে পারে না যে, আমি যেখানে থাকি আমাকে তুমি একটুকু মাধুর্যের সঙ্গে ভাবিবে। আমি জানি, আমার উপরে তোমার অল্প একটু শ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল, সেইটুকু আমার একমাত্র সম্বল করিয়া রাখিব। সেইজন্য আমার সব কথা তোমাকে শুনিতে হইবে। আমি হাতজোড় করিয়া বলিতেছি ঠাকুরপো, একটুখানি বসে। “আচ্ছা চলো” বলিয়া বিহারী এখান হইতে অন্যত্র কোথাও যাইতে উদ্যত হইল । বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, যাহা মনে করিতেছ, তাহা নহে। এ ঘরে কোনো কলঙ্ক স্পর্শ করে নাই। তুমি এই ঘরে একদিন শয়ন করিয়াছিলে— এ ঘর তোমার জন্য উৎসগা করিয়া রাখিয়াছি— ঐ