পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰথম পরিচ্ছেদ অক্ষয়কুমারের শ্বশুর হিন্দুসমাজে ছিলেন, কিন্তু তাহার চালচলন অত্যন্ত নব্য ছিল । মেয়েদের তিনি দীর্ঘকাল অবিবাহিত রাখিয়া লেখাপড়া শিখাইতেছিলেন। লোকে আপত্তি করিলে বলিতেন, আমরা কুলীন, আমাদের ঘরে তো চিরকালই এইরূপ প্রথা। তাহার মৃত্যুর পর বিধবা জগত্তারিণীর ইচ্ছা, লেখাপড়া বন্ধ করিয়া মেয়েগুলির বিবাহ দিয়া নিশ্চিন্ত হন। কিন্তু তিনি ঢ়িলা প্রকৃতির স্ত্রীলোক, ইচ্ছা যাহা হয় তাহার উপায় অন্বেষণ করিয়া উঠিতে পারেন না। সময় যতই অতীত হইতে থাকে আর পাচজনের উপর দোষারোপ করিতে থাকেন। জামাতা অক্ষয়কুমার পুরা নব্য। শ্যালীগুলিকে তিনি পাস করাইয়া নব্যসমাজের খোলাখুলি মন্ত্রে সিমলা পাহাড়ে আপিস করিতে হয়। অনেক রাজঘরের দূত, বড়ো সাহেবের সহিত বোঝাপড়া করাইয়া দিবার জন্য বিপদে-আপদে তাহার হাতে-পায়ে আসিয়া ধরে। এই—সকল নানা কারণে শ্বশুরবাড়িতে তাহার পসার বেশি। বিধবা শাশুড়ি তাহাকেই অনাথ পরিবারের অভিভাবক বলিয়া জ্ঞান করেন। শীতের কয় মাস শাশুড়ির পীড়াপীড়িতে তিনি কলিকাতায় তাহার ধনী শ্বশুর গৃহেই যাপন করেন। সেই কয় মাস তাহার শ্যালী-সমিতিতে উৎসব পড়িয়া যায়। সেইরূপ কলিকতা-বাসের সময় একদা শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী পুরবালার সঙ্গে অক্ষয়কুমারের নিম্নলিখিত—মতো কথাবার্তা হয়— পুরবালা। তোমার নিজের বোন হলে দেখতুম কেমন চুপ করে বসে থাকতে ! এতদিনে এক-একটির তিনটি-চারটি করে পাত্ৰ জুটিয়ে আনতে ! ওরা আমার বোন। কিনা— অক্ষয়। মানব-চরিত্রের কিছুই তোমার কাছে লুকোনো নেই। নিজের বোনে এবং স্ত্রীর বোনে যে কত প্ৰভেদ তা এই কাচা বয়সেই বুঝে নিয়েছ। তা ভাই, শ্বশুরের কোনো কন্যাটিকেই পরের হাতে সমর্পণ করতে কিছুতেই মন সরে না— এ বিষয়ে আমার ঔদার্যের অভাব আছে তা স্বীকার করতে হবে । পুরবালা সামান্য একটু রাগের মতো ভাব করিয়া গভীর হইয়া বলিল, “দেখো, তোমার সঙ্গে আমার একটা বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে।” -- অক্ষয়। একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তো মন্ত্র পড়ে বিবাহের দিনেই হয়ে গেছে, আবার আর একটা ! পুরবালা। ওগো, এটা তত ভয়ানক নয়। এটা হয়তো তেমন অসহ্য না হতেও পারে। অক্ষয় যাত্রার অধিকারীর মতো হাত নাড়িয়া বলিল, “সখী, তবে খুলে বলো!” বলিয়া বিশ্ববিটে। গান ধরিল কী জানি কী ভেবেছ মনে, খুলে বলো লালনে ! কী কথা হায় ভেসে যায় ওই ছলছল নয়নে! এইখানে বলা আবশ্যক, অক্ষয়কুমার ঝোকের মাথায় দুটাে-চারটে লাইন গান মুখে মুখে বানাইয়া