পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ ど8 রবীন্দ্র-রচনাবলী হইতে বৃষ্টির মতাে এই তর্ক হইতে কলহ ও কলহ হইতে পুনর্বার সদ্ভাবের সৃষ্টি হইত। এমন-কি, শ্ৰীশ কথঞ্চিৎ উৎসাহের সহিত বলিল, “আমার বোধ হয় আমাদের দেশে যে এত সভাসমিতি আয়োজন-অনুষ্ঠান অকালে ব্যর্থ হয় তার প্রধান কারণ, সে-সকল কার্যে স্ত্রীলোকদের যোগ নেই। রসিকবাবু কী বলেন ?” রসিক। অবস্থগতিকে যদিও স্ত্রীজাতির সঙ্গে আমার বিশেষ সম্বন্ধ নেই। তবু এটুকু জেনেছি, স্ত্রীজাতি হয় যোগ দেন নয় বাধা দেন, হয় সৃষ্টি নয়। প্ৰলয়। অতএব ওঁদের দলে টেনে অন্য সুবিধা যদি—বা নাও হয় তবু বাধার হাত এড়ানো যায়। বিবেচনা করে দেখুন, চিরকুমার-সভার মধ্যে যদি স্ত্রীজাতিকে আপনারা গ্রহণ করতেন তা হলে গোপনে এই সভাটিকে নষ্ট করবার জন্যে ওঁদের উৎসাহ থাকত না, কিন্তু বর্তমান অবস্থায়— শৈল। কুমারসভার উপর স্ত্রীজাতির আক্রোশের খবর রসিকদাদা কোথায় পেলে ? রসিক। বিপদের খরর না পেলে কী আর সাবধান করতে নেই ? একচক্ষু হরিণ যে দিকে কানা ছিল সেই দিক থেকেই তো তীর খেয়েছিল। কুমারসভা যদি স্ত্রীজাতির প্রতিই কানা হন তা হলে সে দিক থেকেই হঠাৎ ঘা খাবেন। শ্ৰীশ । ( বিপিনের প্রতি মৃদুস্বরে ) একচক্ষু হরিণ তো আজ একটা তীর খেয়েছেন, একটি সভ্য ধূলিশায়ী। চন্দ্র। কেবল পুরুষ নিয়ে যারা সমাজের ভালো করতে চায় তারা এক পায়ে চলতে চায়। সেইজন্যেই খানিক দূর গিয়েই তাদের বসে পড়তে হয়। সমস্ত মহৎ চেষ্টা থেকে মেয়েদের দূরে রেখেছি বলেই আমাদের দেশের কাজে প্ৰাণসঞ্চার হচ্ছে না। আমাদের হৃদয়, আমাদের কাজ, আমাদের আশা বাইরে ও অন্তঃপুরে খণ্ডিত । সেইজন্যে আমরা বাইরে গিয়ে বক্তৃতা দিই, ঘরে এসে ভুলি। দেখো অবলাকাস্তবাবু, এখনো তোমার বয়স অল্প আছে, এই কথাটি ভালো করে মনে রেখে— স্ত্রীজাতিকে অবহেলা কোরো না। স্ত্রীজাতিকে যদি আমরা নিচু করে রাখি তা হলে তারাও আমাদের নীচের দিকেই আকর্ষণ করেন ; তা হলে তাদের ভারে আমাদের উন্নতির পথে চলা অসাধ্য। হয়, দু পা চলেই আবার ঘরের কোণে এসেই আবদ্ধ হয়ে পড়ি। তাদের যদি আমরা উচ্চে রাখি তা হলে ঘরের মধ্যে এসে নিজের আদশকে খর্ব করতে লজা বোধ হয় | আমাদের দেশে বাইরে লেজা আছে, কিন্তু ঘরের মধ্যে সেই লজাটি নেই, সেইজন্যেই আমাদের সমস্ত উন্নতি কেবল বাহ্যিাড়ম্বরে পরিণত হয় | শৈল চন্দ্ৰবাবুর এই কথাগুলি আনতমস্তকে শুনিল ; কহিল, “আশীর্বাদ করুন। আপনার উপদেশ যেন বার্থ না হয়, নিজেকে যেন আপনার আদর্শের উপযুক্ত করতে পারি।” একান্ত নিষ্ঠার সহিত উচ্চারিত এই কথাগুলি শুনিয়া চন্দ্রবাবু কিছু বিস্মিত হইলেন । তাহার সকল উপদেশের প্রতি নিমলার তর্কবিহীন বিনম্র শ্রদ্ধার কথা মনে পড়িল। স্নেহদ্র মনে আবার ভাবিলেন, এ যেন নির্মলারই ভাই । চন্দ্র। আমার ভায়ী নির্মলাকে কুমারসভার সভাশ্রেণীতে ভুক্ত করতে আপনাদের কােনাে আপত্তি রসিক। আর কোনো আপত্তি নেই, কেবল একটু ব্যাকরণের আপত্তি। কুমারসভায় কেউ যদি কুমারীবেশে আসেন তা হলে বোপদেবের অভিশাপ । শৈল । বোপদেবের অভিশাপ একালে খাটে না । রসিক। আচ্ছা, অন্তত লোহারামকে তো বাচিয়ে চলতে হবে। আমি তো বােধ করি, স্ত্রীসভার যদি পুরুষসভ্যদের অজ্ঞাতসারে বেশ ও নাম পরিবর্তন করে আসেন তা হলে সহজে নিষ্পত্তি হয় । শ্ৰীশ। তা হলে একটা কৌতুক এই হয় যে, কে স্ত্রী কে পুরুষ নিজেদের এই সন্দেহটা থেকে RTR বিপিন। আমি বোধ হয় সন্দেহ থেকে নিস্কৃতি পেতে পারি।