পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ریم C ) কুঞ্জ-পথে পথে চাদ উকি দেয় আসি, দেখে বিলাসিনীদের মুখভরা হাসি, কর প্রসারণ করি ফিরে সে জাগিয়া বাতায়নে বাতায়নে লাবণ্য মাগিয়া। —হতভাগা ভিক্ষুক আমার বাতায়নটায় যখন আসে তখন তাকে কী দিয়ে ভোলাই বলুন তো! কাব্যশাস্ত্রের রসালে জায়গা যা-কিছু মনে আসে সমস্ত আউড়ে যাই, কিন্তু কথায় চিড়ে ভেজে না। সেই দুর্ভিক্ষের সময় ঐ রুমালখানি বড়ো কাজে লাগবে। ওতে অনেকটা লাবণ্যের সংস্রব আছে। শ্ৰীশ। সে লাবণ্য দৈবাৎ কখনো দেখেছেন রসিকবাবু ? রসিক। দেখেছি বৈকি, নইলে কি ঐ রুমালখানার জন্যে এত লড়াই করি ? আর ঐ যে 'ন' অক্ষরের কথাগুলো আমার মাথার মধ্যে এখনো এক ঝাক ভ্রমরের মতো গুঞ্জন করে বেড়াচ্ছে তাদের সামনে কি একটি কমলবনবিহারিণী মানসীমূর্তি নেই ? শ্ৰীশ। রসিকবাবু, আপনার ঐ মগজটি একটি মৌচাকবিশেষ, ওর ফুকরে ফুকরে কবিত্বের মধু— আমাকে সুদ্ধ মাতাল করে দেবেন দেখছি। { দীর্ঘনিশ্বাসপতন পুরুষবেশী শৈলবালার প্রবেশ শৈল। আমার আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল, মাপ করবেন শ্ৰীশবাবু! শ্ৰীশ। আমি এই সন্ধেবেলায় উৎপাত করতে এলুম, আমাকেও মাপ করবেন অবলাকান্তবাবু! শৈলী। রোজ সন্ধেবেলায় যদি এইরকম উৎপাত করেন তা হলে মাপ করব, নইলে নয়। শ্ৰীশ । আচ্ছা রাজি, কিন্তু এর পরে যখন অনুতাপ উপস্থিত হবে তখন প্ৰতিজ্ঞা স্মরণ করবেন। শৈল। আমার জন্যে ভাববেন না, কিন্তু আপনার যদি অনুতাপ উপস্থিত হয় তা হলে আপনাকে নিষ্কৃতি দেব। শ্ৰীশ। সেই ভরসায় যদি থাকেন তা হলে অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হবে। শৈলী। রসিকদাদা, তুমি শ্ৰীশবাবুর পকেটের দিকে হাত বাড়ােচ্ছ কেন ? বুড়ো-বয়সে গাটকাটা ব্যাবসা ধরবে না কি ? রসিক। না ভাই, সে ব্যাবসা তোদের বয়সেই শোভা পায়। একখানা রুমাল নিয়ে শ্ৰীশবাবুতে আমাতে তকরার চলছে, তোকে তার মীমাংসা করে দিতে হবে। শৈল | কিরকম ? রসিক। প্রেমের বাজারে বড়ো মহাজনি করবার মূলধন আমার নেই, আমি খুচরো মালের কারবারী— রুমালটা, চুলের দড়িটা, ছেড়া কাগজে দু-চারটে হাতের অক্ষর, এই-সমস্ত কুড়িয়ে-বাড়িয়েই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। শ্ৰীশবাবুর যেরকম মূলধন আছে তাতে উনি বাজারসুদ্ধ পাইকেরি দরে কিনে নিতে পারেন, রুমাল কেন সমস্ত নীলাঞ্চলে অর্ধেক ভাগ বসাতে পারেন ; আমরা যেখানে চুলের দড়ি গলায় জড়িয়ে মরতে ইচ্ছে করি উনি যে সেখানে আগুলফবিলম্বিত চিকুররাশির সুগন্ধ ঘনবন্ধকারের মধ্যে সম্পূর্ণ অস্ত যেতে পারেন। উনি উষ্ণুবৃত্তি করতে আসেন কেন ? শ্ৰীশ। অবলাকাস্তবাবু, আপনি তো নিরপেক্ষ ব্যক্তি, রুমালখানা এখন আপনার হাতেই থাক, উভয় পক্ষের বক্তৃতা শেষ হয়ে গেলে বিচারে যার প্রাপ্য হয় তাকেই দেবেন। শৈলা। (রুমালখানি পকেটে পুরিয়া ) আমাকে আপনি নিরপেক্ষ লোক মনে করছেন বুঝি ? এই কোণে যেমন একটি “ন’ অক্ষর লাল সুতোয় সেলাই করা আছে আমার হৃদয়ের একটি কোণে খুঁজলে দেখতে পাবেন ঐ অক্ষরটি রক্তের বর্ণে লেখা আছে। এ রুমাল আমি আপনাদের কাউকেই দেব না । শ্ৰীশ। রসিকবাবু, এ কিরকম জবৰ্দস্তি ? আর “ন’ অক্ষরটিও তো বড়ো ভয়ানক অক্ষর ! রসিক। শুনেছি বিলিতি শাস্ত্রে ন্যায়ধর্মও অন্ধ, ভালোবাসাও অন্ধ। এখন দুই অন্ধে লড়াই হােক, যার বল বেশি তারই জিত হবে।