পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ऊठजृशङ्क्ऱूितः ०२ S নেশন একটি সজীব সত্তা, একটি মানস পদার্থ। দুইটি জিনিস এই পদার্থের অন্তঃপ্রকৃতি গঠিত করিয়াছে। সেই দুটি জিনিস বস্তুত একই। তাহার মধ্যে একটি অতীতে অবস্থিত, আর-একটি বর্তমানে। একটি হইতেছে সর্বসাধারণের প্রাচীন স্মৃতিসম্পদ, আর-একটি পরস্পর সম্মতি, একত্রে বাস করিবার ইচ্ছা— যে অখণ্ড উত্তরাধিকার হস্তগত হইয়াছে তাহাকে উপযুক্ত ভাবে রক্ষা করিবার ইচ্ছা। মানুষ উপস্থিতমত নিজেকে হাতে হাতে তৈরি করে না। নেশনও সেইরূপ সুদীর্ঘ অতীত কালের প্ৰয়াস, ত্যাগাস্বীকার এবং নিষ্ঠা হইতে অভিব্যক্ত হইতে থাকে। আমরা অনেকটা পরিমাণে আমাদের পূর্বপুরুষের দ্বারা পূর্বেই গঠিত হইয়া আছি। অতীতের বীর্য, মহত্ত্ব, কীর্তি, ইহার উপরেই ন্যাশনাল ভাবের মূলপত্তন। অতীত কালে সর্বসাধারণের এক গৌরব এবং বর্তমান কালে সর্বসাধারণের এক ইচ্ছা, পূর্বে একত্রে বড়ো কাজ করা এবং পুনরায় একত্রে সেইরূপ কাজ করিবার সংকল্প— ইহাই জনসম্প্রদায়-গঠনের ঐকান্তিক মূল। আমরা যে পরিমাণে ত্যাগাস্বীকার করিতে সম্মত হইয়াছি এবং যে পরিমাণে কষ্ট সহ্য করিয়াছি আমাদের ভালোবাসা সেই পরিমাণে প্রবল হইবে। আমরা যে বাড়ি নিজেরা গড়িয়া তুলিয়াছি এবং উত্তরবংশীয়দের হস্তে সমর্পণ করিব, সে বাড়িকে আমরা ভালোবাসি। এই অতি সরল কথাটি সর্বদেশের ন্যাশনাল গাথাস্বরূপ। অতীতের গৌরবময় স্মৃতি ও সেই স্মৃতির অনুরূপ। ভবিষ্যতের আদর্শ- একত্রে দুঃখ পাওয়া, আনন্দ করা, আশা করা— এইগুলিই আসল জিনিস, জাতি ও ভাষার বৈচিত্ৰ্যসত্ত্বেও এগুলির মাহাত্মা বোঝা যায় ; একত্রে মাসুলখানা-স্থাপন বা সীমান্তনির্ণয়ের অপেক্ষা ইহার মূল্য অনেক বেশি। একত্রে দুঃখ পাওয়ার কথা এইজন্য বলা হইয়াছে যে, আনন্দের চেয়ে দুঃখের বন্ধন দৃঢ়তর। অতীতে সকলে মিলিয়া ত্যাগদুঃখ-স্বীকার এবং পুর্নবার সেইজন্য সকলে মিলিয়া প্ৰস্তুত থাকিবার ভাব হইতে জনসাধারণকে যে একটি একীভূত নিবিড় অভিব্যক্তি দান করে তাহাই নেশন। ইহার পশ্চাতে একটি অতীত আছে বটে, কিন্তু তাহার প্রত্যক্ষগম্য লক্ষণটি বর্তমানে পাওয়া যায়। তাহা আর কিছু নহে— সাধারণ সম্মতি, সকলে মিলিয়া একত্রে জীবন বহন করিবার সুস্পষ্টপরিব্যক্তি ইচ্ছা। রোনা বলিতেছেন, আমরা রাষ্ট্রতন্ত্র হইতে রাজার অধিকার ও ধর্মের আধিপত্য নির্বাসিত করিয়াছি, এখন বাকি কী রহিল ? মানুষ, মানুষের ইচ্ছা, মানুষের প্রয়োজন-সকল । অনেকে বলিবেন, ইচ্ছা! ন্যাশনালিটির মতো প্ৰাচীন মহৎসম্পদ রক্ষার ভার দিলে, ক্ৰমে যে সমস্ত বিশ্লিষ্ট হইয়া নষ্ট হইয়া যাইবে । মানুষের ইচ্ছার পরিবর্তন আছে— কিন্তু পৃথিবীতে এমন-কিছু আছে যাহার পরিবর্তন নাই ? নেশনরা অমর নহে। তাহাদের আদি ছিল, তাহদের অন্তও ঘটিবে। হয়তো এই নেশনদের পরিবর্তনকালে এক যুরোপীয় সম্প্রদায় সংঘটিত হইতেও পারে। কিন্তু এখনো তাহার লক্ষণ দেখি না। এখনকার পক্ষে এই নেশন—সকলের ভিন্নতাই ভালো, তাহাঁই আবশ্যক । তাহারাই সকলের স্বাধীনতা রক্ষা করিতেছে— এক আইন, এক প্ৰভু হইলে, স্বাধীনতার পক্ষে সংকট । বৈচিত্ৰ্য এবং অনেক সময় বিরোধী প্রবৃত্তি দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন নেশন সভ্যতাবিস্তারকার্যে সহায়তা করিতেছে। মনুষ্যত্বের মহাসংগীতে প্ৰত্যেকে এক-একটি সুর যোগ করিয়া দিতেছে, সবটা একত্রে মুলিয়া বাস্তবলােকে যে একটি কল্পনাগমা মহিমার সৃষ্টি করিতেছে তাহা কাহারও একক চেষ্টার VSTVS যাহাই হউক, রেনা বলেন— মানুষ জাতির, ভাষার, ধর্মমতের বা নদী পর্বতের দাস নহে। অনেকগুলি সংযতমনা ও ভাবোত্তপ্তহৃদয় মনুষ্যের মহাসংঘ যে একটি সচেতন চরিত্র সৃজন করে তাহাই নেশন। সাধারণের মঙ্গলের জন্য ব্যক্তিবিশেষের ত্যাগ-স্বীকারের দ্বারা এই চরিত্র-চিত্ৰ যতক্ষণ নিজের বল সপ্ৰমাণ করে ততক্ষণ তাহাকে সঁচা বলিয়া জানা যায় এবং ততক্ষণ তাহার টিকিয়া থাকিবার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।