পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মশক্তি V. Sa জন্য তাহার সমস্ত শীর্ণ শাখাপ্ৰশাখা উপরে তুলিয়া দরখাস্ত জারি করিতেছে। নাহয় তাহার দরখাস্ত মঞ্জর হইল, কিন্তু এই সমস্ত আকাশকুসুম লইয়া তাহার সার্থকতা কী ? ইংরেজিতে যাহাকে স্টেট বলে, আমাদের দেশে আধুনিক ভাষায় তাহাকে বলে সরকার। এই রাজশক্তির প্রভেদ আছে। বিলাত, দেশের সমস্ত কল্যাণকর্মের ভার স্টেটের হাতে সমর্পণ করিয়াছে।--ভারতবর্ষ তাহা আংশিকভাবে মাত্ৰ করিয়াছিল। দেশের র্যাহারা গুরুস্থানীয় ছিলেন, যাহারা সমস্ত দেশকে বিনা বেতনে বিদ্যাশিক্ষা ধর্মশিক্ষা দিয়া আসিয়াছেন, তাহাদিগকে পালন করা পুরস্কৃত করা যে রাজার কর্তব্য ছিল না। তাহা নহে— কিন্তু কেবল আংশিকভাবে ; বস্তুত সাধারণত সে কর্তব্য প্রত্যেক গৃহীর। রাজা যদি সাহায্য বন্ধ করেন, হঠাৎ যদি দেশ অরাজক হইয়া আসে, তথাপি সমাজের বিদ্যাশিক্ষা ধর্মশিক্ষা একান্ত ব্যাঘাতপ্ৰাপ্ত হয়। না। রাজা যে প্রজাদের জন্য দীঘিকা খনন করিয়া দিতেন না, তাহা নহে— কিন্তু সমাজের সম্পন্ন ব্যক্তিমাত্ৰই যেমন দিত, তিনিও তেমনি দিতেন । রাজা অমনোযোগী হইলেই দেশের জলপাত্র রিক্ত হইয়া যাইত না । বিলাতে প্ৰত্যেকে আপনি আরাম-আমোদ ও স্বার্থসাধনে স্বাধীন— তাহারা কর্তব্যভারে আক্রান্ত নহে- তাহাদের সমস্ত বড়ো বড়ো কর্তব্যভার রাজশক্তির উপর স্থাপিত। আমাদের দেশে রাজশক্তি অপেক্ষাকৃত স্বাধীন— প্রজাসাধারণ সামাজিক কর্তব্যদ্বারা আবদ্ধ । রাজা যুদ্ধ করিতে যান, শিকার করিতে যান, রাজকাৰ্য্য করুন, বা আমোদ করিয়া দিন কাটান, সেজন্য ধর্মের বিচারে তিনি দায়ী হইবেন— কিন্তু জনসাধারণ নিজের মঙ্গলের জন্য তাহার উপরে নিতান্ত নির্ভর করিয়া বসিয়া থাকে না— সমাজের কাজ সমাজের প্রত্যেকের উপরেই আশ্চর্যরূপে বিচিত্ররূপে ভাগ করা রহিয়াছে | এইরূপ থাকাতে আমরা ধর্ম বলিতে যাহা বুঝি, তাহা সমাজের সর্বত্ৰ সঞ্চারিত হইয়া আছে। আমাদের প্রত্যেককেই স্বার্থসংযম ও আত্মত্যাগচৰ্চা করিতে হইয়াছে। আমরা প্ৰত্যেকেই ধর্মপালন করিতে বাধ্য। ইহা হইতে স্পষ্ট বুঝা যাইবে, ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার প্রাণশক্তি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত। সাধারণের কল্যাণভার যেখানেই পুঞ্জিত হয়, সেইখানেই দেশের মর্মস্থান। সেইখানে আঘাত করিলেই সমস্ত দেশ সাংঘাতিকরূপে আহত হয়। বিলাতে রাজশক্তি যদি বিপর্যস্ত হয়, তবে সমস্ত দেশের বিনাশ উপস্থিত হয়। এইজন্যই যুরোপে পলিটিক্স এত অধিক গুরুতর ব্যাপার। আমাদের দেশে সমাজ যদি পঙ্গু হয়, তবেই যথার্থভাবে দেশের সংকটাবস্থা উপস্থিত হয়। এইজন্য আমরা এতকাল রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য প্ৰাণপণ করি নাই। কিন্তু সামাজিক স্বাধীনতা সর্বতোভাবে বাচাইয়া আসিয়াছি। নিঃস্বকে ভিক্ষাদান হইতে সাধারণকে ধর্মশিক্ষাদান এ সমস্ত বিষয়েই বিলাতে স্টেটের উপর নির্ভর— আমাদের দেশে ইহা জনসাধারণের ধর্মব্যবস্থার উপরে প্রতিষ্ঠিত— এইজন্য ইংরেজ স্টেটকে বাচাইলেই বাচে, আমরা ইংলণ্ডে স্বভাবতই স্টেটকে জাগ্রত রাখিতে সচেষ্ট রাখিতে জনসাধারণ সর্বদাই নিযুক্ত। সম্প্রতি আমরা ইংরেজের পাঠশালায় পড়িয়া স্থির করিয়াছি, অবস্থা-নির্বিচারে। গবমেন্টকে খোচা মারিয়া মনোযোগী করাই জনসাধারণের সর্বপ্রধান কর্তব্য। ইহা বুঝিলাম না যে, পরের শরীরে নিয়তই বেলেঞ্জা লাগাইতে থাকিলে নিজের ব্যাধির চিকিৎসা করা হয় না । আমরা তর্ক করিতে ভালোবাসি, অতএব এ তর্ক এখানে ওঠা অসম্ভব নহে যে, সাধারণের কর্মভার সাধারণের সর্বাঙ্গেই সঞ্চারিত হইয়া থাকা ভালো, না, তাহা বিশেষভাবে সরকার-নামক একটা জায়গায় নির্দিষ্ট হওয়া ভালো। আমার বক্তব্য এই যে, এ তর্ক বিদ্যালয়ের ডিবেটিং ক্লাবে করা যাইতে পারে, কিন্তু আপাতত এ তর্ক আমাদের কোনো কাজে লাগিবে না। কারণ এ কথা আমাদিগকে বুঝিতেই হইবে, বিলাতরাজ্যের স্টেট সমস্ত সমাজের সম্মতির উপরে