পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মশক্তি N28 Գ রাখিয়া আমাদের মধ্যে ঐক্যের পথগুলিকে যথাসম্ভব রোধ করিতে উদ্যত হইয়া থাকেন, সে আশঙ্কা কিরূপ প্রতিবাদের দ্বারা আমরা দূর করিতে পারি। সভাস্থলে কি এমন বাক্যের ইন্দ্ৰজাল আমরা সৃষ্টি করিব যাহার দ্বারা তাহারা এক মুহূর্তে আশ্বস্ত হইবেন ? আমরা কি এমন কথা বলিতে পারি যে, ইংরেজ অনন্তকাল আমাদিগকে শাসনাধীনে রাখিবেন ইহাই আমাদের একমাত্র শ্রেয় ? যদি বা বলি, তবে ইংরেজ কি আপোগণ্ড অর্বাচীন যে এমন কথায় মুহূর্তকালের জন্য শ্রদ্ধাস্থাপন করিতে পরিবে ? আমাদিগকে এ কথা বলিতেই হইবে এবং না। বলিলেও ইহা সুস্পষ্ট যে, যে-পর্যন্ত না আমাদের নানা জাতির মধ্যে ঐক্যসাধনের শক্তি যথার্থভাবে স্থায়িভাবে উদ্ভূত হয়, সে-পর্যন্ত ইংরেজের রাজত্ব আমাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় ; কিন্তু পরদিনেই আর নহে। ] এমন স্থলে ইংরেজ যদি মমতায় মগ্ধ হইয়া, যদি ইংরেজি জাতীয় স্বার্থের দিকে তাকাইয়া— সেই স্বার্থকে যত বড়ো নামই দাও-না কেন, নাহয় তাহাকে ইম্পরিয়ালিজমই বলো— যদি স্বার্থের দিকে তাকাইয়া ইংরেজ বলে, আমাদের ভারত-রাজ্যকে আমরা পাকাপাকি চিরস্থায়ী করিব, আমরা সমস্ত ভারতবর্ষকে এক হইতে দিবার নীতি অবলম্বন করিব না, তবে নিরতিশয় উচ্চ-অঙ্গের ধর্মোপদেশ ছাড়া এ কথার কী জবাব আছে। এ কথাটা সত্য যে, আমাদের দেশে সাহিত্য ক্রমশই প্ৰাণবান বলবান হইয়া উঠিতেছে ; এই সাহিত্য ক্রমশই অল্পে অল্পে সমাজের উচ্চ হইতে নিম্ন স্তর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতেছে ; যে-সকল জ্ঞান, যে-সকল ভাব কেবল ইংরেজিশিক্ষিতদের মধ্যেই বদ্ধ ছিল, তাহা আপামর সাধারণের মধ্যে বিস্তারিত হইতেছে ; এই উপায়ে ধীরে ধীরে সমস্ত দেশের ভাবনা, বেদনা, লক্ষ্য এক হইয়া পরিস্ফুট হইয়া উঠিতেছে ; এক সময়ে যে-সকল কথা কেবল বিদেশী পাঠশালার মুখস্থ কথা মাত্র ছিল এখন তাহা দিনে দিনে স্বদেশের ভাষায় স্বদেশের সাহিত্যে স্বদেশের আপনি কথা হইয়া দাড়াইতেছে । আমরা কি বলিতে পারি না, তাহা হইতেছে না” এবং বলিলেই কি কাহারও চোখে ধূলা দেওয়া হইবে ? জ্বলন্ত দীপ কি শিখা নাডিয়া বলিবে- না, তাহার আলো নাই ? এমন অবস্থায় ইংরেজ যদি এই উত্তরোত্তর ব্যাপ্যমান সাহিত্যের ঐক্যস্রোতকে অন্তত চারটে বড়ো বড়ো বাধা দিয়া বাধিয়া নিশ্চল ও নিস্তেজ করিতে ইচ্ছা করেন, তবে আমরা কী বলিতে পারি ? আমরা এই বলিতে পারি যে, এমন করিলে যে ক্রমশ আমাদের ভাষার উন্নতি প্ৰতিহত এবং আমাদের সাহিত্য নিজীবী হইয়া পড়িবে। যখন বাংলাদেশকে দুই অংশে ভাগ করিবার প্রস্তাব প্রথম উত্থাপিত হইয়াছিল, তখনো আমরা বলিয়াছিলাম, এমন করিলে যে আমাদের মধ্যে প্ৰভেদ উত্তরোত্তর পরিণত ও স্থায়ী হইয়া দাড়াইবে। কাঠুরিয়া যখন বনস্পতির ডাল কাটে, তখন যদি বনস্পতি বলে, আহা কী করিতেছ, আমন করিলে যে আমার ডালগুলা যাইবে- তবে কাঠুরিয়ার জবাব এই যে, ডাল কাটিলে যে ডাল কাটা পড়ে তাহা কি আমি জানি না, আমি কি শিশু ! কিন্তু তবুও তর্কের উপরেই ভরসা | রাখিতে হইবে ? আমরা জানি পার্লামেন্টে ও তর্ক হয়, সেখানে এক পক্ষ আর-এক পক্ষের জবাব দেয় ; সেখানে এক পক্ষ আর-এক পক্ষকে পরাস্ত করিতে পারিলে ফললাভ করিল বলিয়া খুশি হয়। আমরা কোনোমতেই ভুলিতে পারি না— এখানেও ফললাভের উপায় সেই একই ! কিন্তু উপায় এক হইতেই পারে না। সেখানে দুই পক্ষই যে বাম-হাত ডান-হাতের ন্যায় একই শরীরের অঙ্গ। তাহদের উভয়ের শক্তির আধার যে একই। আমরাও কি তেমনি একই ? গর্বমেন্টের শক্তির প্রতিষ্ঠা যেখানে আমাদেরও শক্তির প্রতিষ্ঠা কি সেইখানে ? তাহারা যে-ডাল নাড়া দিলে যে-ফল পড়ে আমরাও কি সেই ডালটা নাড়িলেই সেই ফল পাইব ? উত্তর দিবার সময় পুঁথি খুলিয়ো না। ; এ সম্বন্ধে মিল কী বলিয়াছেন, স্পেনসর কী বলিয়াছেন, সীলি কী বলিয়াছেন, তাহা জানিয়া আমার সিকি-পয়সার লাভ নাই। প্ৰত্যক্ষ শাস্ত্ৰ সমস্ত দেশ ব্যাপ্ত করিয়া খোলা রহিয়াছে। খুব বেশিদূর তলাইবার দরকার নাই; নিজের মনের মধ্যেই একবার দৃষ্টিপাত করে।া-না । যখন য়ুনিভার্সিটি-বিল লইয়া আমাদের মধ্যে একটা আন্দোলন উঠিয়াছিল, তখন আমরা কিরূপ সন্দেহ করিয়াছিলাম ? আমরা সন্দেহ করিয়াছিলাম যে, গবর্মেন্ট আমাদের বিদ্যার উন্নতিকে বাধা দিবার চেষ্টা করিতেছেন।