পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মশক্তি \ე (č (& পারি— রিপনের জয় হউক এবং কর্জনও বাচিয়া থাকুন। আমি পুনরায় বলিতেছি, দেশের বিদ্যাশিক্ষার ভার আমাদিগকে গ্ৰহণ করিতে হইবে। সংশয়ী বলিবেন, শিক্ষার ভার যেন আমরা লইলাম, কিন্তু কৰ্ম দিবে কে ? কৰ্মও আমাদিগকে দিতে হইবে একটি বৃহৎ স্বদেশী কর্মক্ষেত্র আমাদের আয়ত্তগত না থাকিলে আমাদিগকে চিরদিনই দুর্বল থাবি হইবে, কোনো কৌশলে এই নিজীব দুর্বলতা হইতে নিস্কৃতি পাইব না। যে আমাদিগকে কর্ম দিবে সেই আমাদের প্রতি কর্তৃত্ব করিবে, ইহার অন্যথা হইতেই পারে না— যে কর্তৃত্ব লাভ করিবে সে আমাদিগকে চালনা করিবার কালে নিজের স্বাৰ্থ বিস্মৃত হইবে না। ইহাও স্বাভাবিক। অতএব সর্বপ্রযত্নে আমাদিগকে এমন একটি স্বদেশী কর্মক্ষেত্র গড়িয়া তুলিতে হইবে যেখানে স্বদেশী বিদ্যালয়ের শিক্ষিতগণ শিক্ষকতা, পূর্তকার্য, চিকিৎসা প্রভৃতি দেশের বিচিত্র মঙ্গলকমের ব্যবস্থায় নিযুক্ত থাকিবেন। আমরা আক্ষেপ করিয়া থাকি যে, আমরা কাজ শিখিবার ও কাজ দেখাইবার অবকাশ না পাইয়া মানুষ হইয়া উঠিতে পারি না। সে অবকাশ পরের দ্বারা কখনোই সন্তোষজনকররূপে হইতে পারে না, তাহার প্রমাণ পাইতে আমাদের বাকি নাই । আমি জানি, অনেকেই বলিবেন কথাটা অত্যন্ত দুরূহ শোনাইতেছে। আমিও তাহা অস্বীকার করিতে পারিব না। ব্যাপারখানা সহজ নহে— সহজ যদি হইতে, তবে আশ্রদ্ধেয় হইত। কেহ যদি দরখাস্ত-কাগজের নৌকা বানাইয়া সাত-সমুদ্ৰ-পারে সাত রাজার ধন মানিকের ব্যাবসা চালাইবার প্ৰস্তাব করে, তবে কারও-কার ও কাছে তাহা শুনিতে লোভনীয় হয়, কিন্তু সেই কাগজের নৌকার বাণিজ্যে কাহাকেও মূলধন খরচ করিতে পরামর্শ দিই না। বাধ বাধা কঠিন, সে স্থলে দল বাধিয়া নদীকে সরিয়া বসিতে অনুরোধ করা কনস্টিটুৰ্দশনাল অ্যাজিটেশন নামে গণ্য হইতে পারে। তাহা সহজ কাজ বটে, কিন্তু সহজ উপায় নহে। আমরা সস্তায় বড়ো কােজ সারিবার চাতুরী অবলম্বন করিয়া থাকি, কিন্তু সেই সস্তা উপায় বারংবার যখন ভাঙিয়া ছারখার হইয়া যায়। তখন পরের নামে দোষারোপ করিয়া তৃপ্তিবোধ করি।-- তাহাতে তৃপ্তি হয়, কিন্তু কাজ হয় না । নিজেদের বেলায় সমস্ত দায়কে হালকা করিয়া পরের বেলায় তাহাকে ভাবা করিয়া তোলা কর্তবানীতির বিধান নহে। আমাদের প্রতি ইংরেজের আচরণ যখন বিচার করিব তখন সমস্ত বাধাবিঘ্ন এবং মনুষ্য-প্রকৃতির স্বাভাবিক দুর্বলতা আলোচনা করিয়া আমাদের প্রত্যাশার অঙ্ককে যতদূর সম্ভব খাটো করিয়া আনিতে হইবে ! কিন্তু, আমাদের নিজের কর্তব্য বিবেচনা করিবার সময় ঠিক তাহার উলটা দিকে চলিতে হইবে । নিজের বেলায় ও জর বানাইব না, নিজেকে ক্ষমা কবিতে পারিব না, কোনো উপস্থিত সুবিধার খাতিরে নিজের আদর্শকে খর্ব করার প্রতি আমরা আস্থা রাখিব না। সেইজন্য আমি আজ বলিতেছি, ইংরেজের উপর রাগােরাগিা করিয়া ক্ষণিক উত্তেজনামূলক উদযোগে প্ৰবৃত্ত হওয়া সহজ, কিন্তু সেই সহজ পথ শ্রেয়ের পথ নহে! জবাব দিবার, জব্দ করিবার প্রবৃত্তি আমাদিগকে যথার্থ কর্তব্য হইতে, সফলতা হইতে ভ্ৰষ্ট করে। লোকে যখন রাগ করিয়া মোকদ্দমা করিতে উদ্যত হয় তখন নিজের সর্বনাশ করিতেও কুষ্ঠিত হয় না। আমরা যদি সেইরূপ মনস্তাপের উপর কেবলই উষ্ণবাক্যের ফু দিয়া নিজেকে রাগাইয়া তুলিবারই চেষ্টা করি, তাহা হইলে ফললাভের লক্ষ্য দূরে দিয়া ক্রোধের পরিতৃপ্তিটাই বড়ো হইয়া উঠে। যথার্থভাবে গভীরভাবে দেশের স্থায়ী মঙ্গলের দিকে লক্ষ্য রাখিতে হইলে এই ক্ষুদ্র প্রবৃত্তির হাত হইতে নিজেকে মুক্তি দিতে হইবে। নিজেকে ক্রুদ্ধ এবং উত্তাক্ত অবস্থায় রাখিলে সকল ব্যাপারে পরিমাণবোধ চলিয়া যায়— ছোটো কথাকে বড়ো করিয়া তুলি— প্ৰত্যেক তুচ্ছতাকে অবলম্বন করিয়া অসংগত অমিতাচারের দ্বারা নিজের গাম্ভীর্য নষ্ট করিতে থাকি। এইরূপ চাঞ্চল্য দ্বারা দুর্বলতার বৃদ্ধিই হয়— ইহাকে শক্তির চালনা বলা যায় না, ইহা অক্ষমতার আক্ষেপ } এই-সকল ক্ষুদ্রতা হইতে নিজেকে উদ্ধার করিয়া দেশের প্রতি প্রীতির উপরেই দেশের মঙ্গলকে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে- স্বভাবের দুর্বলতার উপরে নহে, পরের প্রতি বিদ্বেষের উপর নহে এবং পরের প্রতি অন্ধ নিৰ্ভরের উপরেও নহে। এই নির্ভর এবং এই বিদ্বেষ দেখিতে যেন পরস্পর বিপরীত