পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ\ეNტ রবীন্দ্র-রচনাবলী উজ্জ্বল তন্ত্রীগুলিতে এখনো অব্যবহারে মরিচা পড়িয়া যায় নাই- উদার উদ্দেশ্যের প্রতি নিবিচারে আত্মবিসর্জন করিবার দিকে মানুষের মনের যে-একটা স্বাভাবিক ও সুগভীর প্রেরণা আছে তোমাদের অন্তঃকরণে এখনো তাহা ক্ষুদ্র বাধার দ্বারা বারংবার প্রতিহত হইয়া নিস্তেজ হয় নাই। আমি জানি, স্বদেশ যখন অপমানিত হয় আহত অগ্নির ন্যায় তোমাদের হৃদয় উদ্দীপ্ত হইয়া উঠে, নিজের ব্যবসায়ের সংকীর্ণতা ও স্বার্থসাধনের চেষ্টা তোমাদের সমস্ত মনকে গ্ৰাস করে নাই; দেশের অভাব ও অগেীর যে কেমন করিয়া দূর হইতে পারে সেই চিন্তা নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে তোমাদের রজনীর বিনিদ্র প্রহর ও দিবসের নিভৃত অবকাশকে আক্রমণ করে ; আমি জানি, ইতিহাসবিশ্রুত যে-সকল মহাপুরুষ দেশহিতের জন্য লোকহিতের জন্য আপনাকে উৎসর্গ করিয়া মৃত্যুকে পরাস্ত, স্বার্থকে লজ্জিত ও দুঃখক্লেশকে অমর মহিমায় সমুজ্জ্বল করিয়া গেছেন,তাহাদের দৃষ্টান্ত তোমাদিগকে যখন আহবান করে তখন তাহাকে আজও তোমরা বিজ্ঞ বিষয়ীর মতো বিদ্রুপের সহিত প্ৰত্যাখ্যান করিতে চাও না— তোমাদের সেই অনাঘাত পুষ্প অখণ্ড পুণ্যের ন্যায় হৃদয়ের সমস্ত আশা-আকাঙক্ষাকে আমি আজ তোমাদের দেশের সারস্বতবগের নামে আহবান করিতেছি— ভোগের পথে নহে, ভিক্ষার পথে নহে, কর্মের পথে। কর্মশালার প্রবেশদ্বার অতি ক্ষুদ্র, রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারের ন্যায়। ইহা অভ্ৰভেদী নহে। কিন্তু গৌরবের বিষয় এই যে, এখানে নিজের শক্তি সম্বল করিয়া প্ৰবেশ করিতে হয়, ভিক্ষাপাত্ৰ লইয়া নহে— গৌরবের বিষয় এই যে, এখানে প্রবেশের জন্য দ্বারীর অনুমতির অপমান স্বীকার করিতে হয় না, ঈশ্বরের আদেশ শিরোধাৰ্য করিয়া আসিতে হয়— এখানে প্ৰবেশ করিতে গেলে মাথা নত করিতে হয় বটে, কিন্তু সে কেবল নিজের উচ্চ আদর্শের নিকট, দেশের নিকট, যিনি নত ব্যক্তিকে উন্নত করিয়া দেন। সেই মঙ্গলবিধাতার নিকট । তোমাদিগকে আহবান করিয়া এ পর্যন্ত কেহ তো সম্পূর্ণ নিরাশ হন নাই; দেশ যখন বিলাতি বিষাণ বাজাইয়া ভিক্ষা করিতে বাহির হইয়াছিল তখন তোমরা পশ্চাৎপদ হও নাই, প্রাচীন শ্লোকে যে স্থানটাকে শ্মশানের ঠিক পূর্বেই বসাইয়াছেন সেই রাজদ্বারে তোমরা যাত্ৰা করিয়া আপনাকে সার্থক জ্ঞান করিয়াছ, আর আজ সাহিত্য-পরিষৎ তোমাদিগকে যে আহবান করিতেছেন তাহার ভাষা মাতৃভাষা ও তাহার কার্য মাতার অন্তঃপুরের কার্য বলিয়াই কি তাহা ব্যর্থ হইবে- সে আহবান দেশের উৎসবে ব্যসনে চৈব, কিন্তু ‘রাজদ্বারে শ্মশানে চ’ নয় বলিয়াই কি তোমাদের উৎসাহ হইবে না ? সাহিত্য-পরিষদে আমরা দেশকে জানিবার জন্য প্ৰবৃত্ত হইয়াছি— দেশের কাব্যে, গানে, ছড়ায়, প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষে, কীটদষ্ট পুঁথির জীর্ণ পত্রে, গ্ৰাম্য পার্বণে, ব্ৰতকথায়, পল্লীর কৃষিকুটিরে পরিষৎ যেখানে স্বদেশকে সন্ধান করিবার জন্য উদ্যত হইয়াছেন সেখানে বিদেশী লোকে কোনোদিন বিস্ময়দৃষ্টিপাত করে না, সেখান হইতে সংবাদপত্ৰবাহন খ্যাতি সমুদ্রপারে জয়ঘোষণা করিতে যায় না, সেখানে তোমাদের কোনো প্রলোভন নাই— কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেহ মাতার নিঃশব্দ আশিসমাত্রকে যদি রাজমহিষীর ভোজ্যাবশেষের চেয়ে অধিক মনে করিতে পার। তবে মাতার নিভৃত-অন্তঃপুরচারী এই-সকল মাতৃসেবকদের পাশ্বে আসিয়া দণ্ডায়মান হও এবং দিনের পর দিন বিনা বেতনে বিনা পুরস্কারে খ্যাতিবিহীন কর্মে স্বদেশপ্রেমকে সার্থক করো। তাহা হইলে অন্তত এইটুকু বুঝিবে যে, যদি শক্তি থাকে। তবে কর্মও আছে, যদি প্রীতি থাকে। তবে সেবার উপলক্ষের অভাব নাই, সেজন্য গবমেন্টের কোনো আইন-পাসের অপেক্ষা করিতে হয় না এবং কোনো অধিকারভিক্ষার প্রত্যাশায় রুদ্ধ দ্বারের কাছে অনন্যকর্ম হইয়া দিনরাত্রি যাপন করা অত্যাবশ্যক নহে। কথাটা তো শুদ্ধমাত্র এই যে, দেশী ভাষার ব্যাকরণ চর্চা করো, অভিধান সংকলন করো, পল্লী হইতে দেশের আভ্যন্তরিক বিবরণ সংগ্রহ করো। এই সামান্য প্ৰস্তাবের অবতারণার জন্য এমন করিয়া উচ্চভাবের দোহাই দিয়া দীর্ঘ ভূমিকা রচনা করা কিছু যেন অসংগত হইয়াছে। হইয়াছে স্বীকার করি, কিন্তু কালের গতিকে এইরূপ অসংগত ব্যাপার আমাদের দেশে আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে ইহাই আমাদের দুর্ভাগ্যের লক্ষণ। যদি কোনো মাতার এমন অবস্থা হয় যে, ছেলের প্রতি তাহার কর্তব্য কী