পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○br রবীন্দ্র-রচনাবলী বিলাতি য়ুনিভার্সিটিগুলাও একেবারেই আকাশ হইতে পড়িয়া অথবা কোনো জবরদস্ত শাসনকর্তার আইনের জোরে এক রাত্রে পূর্ণপরিণত হইয়া, উঠে নাই। তাহার একটা ইতিহাস আছে। দেশের অবস্থা এবং ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে তাহারা স্বভাবত বাড়িয়া উঠিয়াছে। ইহার প্রতিবাদে বলা যাইতে পারে, আমাদের য়ুনিভার্সিটি গোড়াতেই বিদেশের নকল— স্বাভাবিক নিয়মের কথা ইহার সম্বন্ধে খাটিতে পারে না । সে কথা ঠিক। ভারতবর্ষের য়ুনিভার্সিটি দেশের প্রকৃতির সঙ্গে যে মিশিয়া গেছে, আমাদের সমাজের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাঙ্গ হইয়া গেছে, তাহা বলিতে পারি না— এখনো ইহা আমাদের বাহিরে রহিয়াছে। কলেজগুলিই তাহার প্রমাণ । দেখিলে চলিবে না, দেশের লোকের হাতে কী আছে তাহাঁই দেখিতে হইবে। রেলওয়ে টেলিগ্ৰাফ অনেক দেখিতেছি, কিন্তু তাহা আমাদের নহে ; বাণিজ্য-ব্যবসায়ও কম নহে, কিন্তু তাহারও যৎসামান্য আমাদের। রাজ্যশাসনপ্রণালী জটিল ও বিস্তৃত, কিন্তু তাহার যথার্থ কর্তৃত্বভার আমাদের নাই বলিলেই হয় ; তাহার মজুরের কার্যই আমরা করিতেছি, তাহাও উত্তরোত্তর সংকুচিত হইয়া আসিবার লক্ষণ দেখা যাইতেছে। A যে জিনিস। যথার্থ আমাদের তাহা ভালো না হইলেও, তাহার ক্ৰটি থাকিলেও, তাহা ভাণ্ডারকর-মহাশয়ের সম্পূর্ণ মনোনীত না হইলেও, তাহাকেই আমরা লাভ বলিয়া গণ্য করিব। যে বিদ্যা পুঁথিগত, যাহার প্রয়োগ জানা নাই, তাহা যেমন পণ্ড, তেমনি যে শিক্ষাদানপ্রণালী আমাদের আয়ত্তের অতীত তাহাও আমাদের পক্ষে প্ৰায় তেমনি নিম্বফল । দেশের বিদ্যাশিক্ষাদান দেশের লোকের হাতে আসিতেছিল বস্তুত ইহাই বিদ্যাশিক্ষার ফল। সেও যদি সম্পূর্ণ গবর্মেন্টের হাতে গিয়া পড়ে, তবে খুব ভালো য়ুনিভার্সিটিও আমাদের পক্ষে দারিদ্র্যের লক্ষণ। আমাদের দেশে বিদ্যাকে অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য করা কোনোমতেই সংগত নহে। আমাদের সমাজ শিক্ষাকে সুলভ করিয়া রাখিয়াছিল— দেশের উচ্চনীচ সকল স্তরেই শিক্ষা নানা সহজ প্ৰণালীতে প্রবাহিত হইতেছিল। সেই-সমস্ত স্বাভাবিক প্ৰণালী ইংরেজিশিক্ষার ফলেই ক্ৰমে ক্ৰমে বন্ধ হইয়া আসিতেছিল— এমন-কি, দেশে রামায়ণ-মহাভারত-পাঠ কথকতা যাত্রাগান প্রতিদিন বিদায়োম্মুখ হইয়া আসিতেছে। এমন সময়ে ইংরেজিশিক্ষাকেও যদি দুর্লভ করিয়া তোলা হয়, তবে গাছে তুলিয়া দিয়া মই কাডিয়া লওয়া হয় । বিলাতি সভ্যতার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গই অনেক টাকার ধন। আমোদ হইতে লড়াই পর্যন্ত সমস্তই টাকার ব্যাপার। ইহাতে টাকা একটা প্ৰকাণ্ড শক্তি হইয়া উঠিয়াছে এবং টাকার পূজা আর-সমস্ত পূজাকে ছাড়াইয়া চলিয়াছে। এই দুঃসাধ্যতা, দুর্লভতা, জটিলতা যুরোপীয় সভ্যতার সর্বপ্রধান দুর্বলতা। সাতার দিতে গিয়া অত্যন্ত বেশি হাত-পা ছোড়া অপটুতারই প্ৰমাণ দেয় ; কোনো সভ্যতার মধ্যে যখন সর্ব বিষয়েই প্ৰয়াসের একান্ত আতিশয্য দেখা যায় তখন ইহা বুঝিতে হইবে, তাহার যতটা শক্তি বাহিরে দেখা যাইতেছে তাহার অনেকটারই প্রতিমুহূর্তে অপব্যয় হইতেছে। বিপুল মালমসলা-কাঠখড়ের হিসােব যদি ঠিকমত রাখা যায়। তবে দেখা যাইবে, মজুরি পোষাইতেছে না। প্রকৃতির খাতায় সুদে-আসলে হিসাব বাড়িতেছে, মাঝে মাঝে তাগিদের পেয়াদাও যে আসিতেছে না। তাহাও নহে— কিন্তু, সে লইয়া আমাদের ভাবনার বিষয় এই যে, দেশে বিচার দুমূল্য, অন্ন দুর্মুল্য, শিক্ষাও যদি দুমূল্য হয়, তবে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে নিদারুণ বিচ্ছেদ আমাদের দেশেও অত্যন্ত বৃহৎ হইয়া উঠিবে। বিলাতে দারিদ্র্য কেবল ধনের অভাব নহে, তাহা মনুষ্যত্বেরও অভাব।— কারণ, সেখানে মনুষ্যত্বের সমস্ত উপকরণই