পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ኃዒ (፩ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ভারতবর্ষের পলিটিক্সে অবিশ্বাসনীতি রাজার তরফে অত্যন্ত সুদৃঢ়, অথচ আমাদের তরফে তাহা একান্ত শিথিল । আমরা একই কালে অবিশ্বাস প্ৰকাশ করি, কিন্তু বিশ্বাসের বন্ধন ছেদন করি না । ইহাকেই বলে ওরিয়েন্টাল- এইখানেই পাশ্চাত্যদের সঙ্গে আমাদের প্রভেদ | যুরোপ কায়মনোবাক্যে অবিশ্বাস করিতে জানে- আর, ষোলো-আনা অবিশ্বাসকে জাগাইয়া রাখিবার যে কঠিন শক্তি তাহা আমাদের নাই, আমরা ভুলিয়া নিশ্চিন্ত হইতে চাই, আমরা কোনােক্রমে বিশ্বাস করিতে পারিলে বাচি । যাহা অনাবশ্যক তাহাকেও রক্ষা করিবার, যাহা আশ্রদ্ধেয় তাহাকেও গ্ৰহণ করিবার, যাহা প্রতিকূল তাহাকেও অঙ্গীভূত করিবার জন্য আমরা চিরদিন প্রস্তুত হইয়া আছি। যুরোপ যাহা-কিছু পাইয়াছে তাহা বিরোধ করিয়াই পাইয়াছে, আমাদের যাহা-কিছু সম্পত্তি তাহা বিশ্বাসের ধন । এখন বিরোধপরায়ণ জাতির সহিত বিশ্বাসপরায়ণ জাতির বোঝাপড়া মুশকিল। হইয়াছে । স্বভাববিদ্রোহী স্বভাববিশ্বাসীকে শ্রদ্ধাই করে না । স্বভাবতই যে আমাদের ঐক্যের সহায় নহেন, আমাদের ক্ষমতালাভের অনুকূল নহেন, এ কথা আমাদের মনকে অধিকার করিয়াছে। সেইজন্যই য়ুনিভার্সিটি-সংশোধন বঙ্গব্যবচ্ছেদ প্রভৃতি গবমেন্টের ব্যবস্থাগুলিকে আমাদের শক্তি খর্ব করিবার সংকল্প বলিয়া কল্পনা করিয়াছি । এমনতরো সন্দিগ্ধ অবস্থার স্বাভাবিক গতি হওয়া উচিত- আমাদের স্বদেশহিতকর সমস্ত চেষ্টাকে নিজের দিকে ফিরাইয়া আনা । আমাদের অবিশ্বাসের মধ্যে এইটুকুই আমাদের লাভের বিষয় । , পরের নিকট আমাদের সমস্ত প্ৰত্যাশাকে বদ্ধ করিয়া রাখিলে কেবল যে ফল পাওয়া যায় না। তাহা নহে, তাহাতে আমাদের ঈশ্বরপ্রদত্ত আত্মশক্তির মাহাত্ম্য চিরদিনের জন্য নষ্ট হইয়া যায় । এইটেই আমাদিগকে বিশেষ করিয়া মনে রাখিতে হইবে । ইংরেজ আমাদের প্রার্থনাপূরণ করিবে না, অতএব আমরা তাহাদের কাছে। যাইব না— এ সুবুদ্ধিটা লজ্জাকর । বস্তুত এই কথাই আমাদের মনে রাখিতে হইবে, অধিকাংশ স্থলেই প্রার্থনাপূরণটাই আমাদের লোকসান । নিজের চেষ্টার দ্বারা যতটুকু ফল পাই তাহাতে ফলও পাওয়া যায়, শক্তিও পাওয়া যায়, সোনাও পাওয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে পরশপাথরও পাওয়া যায়। পরের দ্বার রুদ্ধ হইয়াছে বলিয়াই ভিক্ষাবৃত্তি হইতে যদি নিরস্ত হইতে হয়, পৌরুষবশত, মনুষ্যত্বাবশত, নিজের প্রতি, নিজের অন্তর্যামী পুরুষের প্রতি সম্মানবশত যদি না হয়, তবে এই ভিক্ষাবৈরাগ্যের প্রতি আমি কোনো ভরসা রাখি না । বস্তুত, ইংরেজের উপর রাগ করিয়া নিজের দেশের উপর হঠাৎ অত্যন্ত মনোযোগ দিতে আরম্ভ করা কেমন- যেমন স্বামীর উপরে অভিমান করিয়া সবেগে বাপের বাড়ি যাওয়া । সে বেগের হ্রাস হইতে বেশিক্ষণ লাগে না, আবার দ্বিগুণ আগ্রহে সেই শ্বশুরবাড়িতেই ফিরিতে হয় । দেশের প্রতি আমাদের যে-সকল কর্তব্য আজ আমরা স্থির করিয়াছি সে যদি দেশের প্রতি প্রীতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয় তবেই তাহার গৌরব এবং স্থায়িত্ব, ইংরেজের প্রতি রাগের উপরে যদি তাহার নির্ভর হয় তবে তাহার উপরে ভরসা রাখা বড়ো কঠিন । ডাক্তার অসম্ভব ভিজিট বাড়াইয়াছে বলিয়া তাহার উপরে রাগ করিয়া যদি শরীর ভালো করিতে চেষ্টা করি তাহাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু শরীরের প্রতি মমতা করিয়া যদি এ কাজে প্ৰবৃত্ত হই। তবেই কাজটা যথার্থভাবে সম্পন্ন হইবার এবং উৎসাহ স্থায়িভাবে রক্ষিত হইবার সম্ভাবনা থাকে । তবে কিনা, যেমন ঘড়ির কল কোনো—একটা আকস্মিক বাধায় বদ্ধ হইয়া থাকিলে তাহাকে প্রথমে একটা নাড়া দেওয়া যায়, তাহার পরেই সে আর দ্বিতীয় বঁাকানির অপেক্ষা না করিয়া নিজের দামেই নিজে চলিতে থাকে- তেমনি স্বদেশের প্রতি কর্তব্যপরতাও হয়তো আমাদের সমাজে একটা বড়োরকমের বঁাকানির অপেক্ষায় ছিল— হয়তো স্বদেশের প্রতি স্বভাবসিদ্ধ প্রীতি এই বঁাকানির পর হইতে নিজের আভ্যন্তরিক শক্তিতেই আবার কিছুকাল সহজে চলিতে থাকিবে । অতএব এই বঁাকানিটা যাহাতে আমাদের মনের উপরে বেশ রীতিমত লাগে। সে পক্ষেও আমাদিগকে সচেষ্ট হইতে হইবে । যদি সাময়িক আন্দােলনের সাহায্যে আমাদের নিত্য জীবনীক্রিয়া সজাগ হইয়া উঠে। তবে এই সুযোগটা