পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মশক্তি \۹۶۹ م যিনি আমাদের সস্তানের মধ্যে আমাদের সাধনাকে সিদ্ধিদান করিবার পথ মুক্ত করিতেছেন, যিনি আমাদের এই সূর্যালোকদীপ্ত নীলাকাশের নিম্নে যুগে যুগে সকলকে একত্ৰ করিয়া এক বিশেষ বাণীর দ্বারা আমাদের সকলের চিত্তকে এক বিশেষ ভাবে উদবোধিত করিতেছেন, আমাদের চিরপরিচিত ছায়ালোকবিচিত্র অরণ্য-প্ৰান্তর-শস্যক্ষেত্র র্যাহার বিশেষ মূর্তিকে পুরুষানুক্রমে আমাদের চক্ষের সম্মুখে প্ৰকাশমান করিয়া রাখিয়াছে, আমাদের পুণ্যনদীসকল র্যাহার পাদোদকরূপে আমাদের গৃহের দ্বারে দ্বারে প্রবাহিত হইয়া যাইতেছে, যিনি জাতিনির্বিশেষে হিন্দু-মুসলমান-খুস্টিানকে এক মহাযজ্ঞে আহবান অন্তর্যামী সেই দেবতাকে, আমাদের সেই চিরন্তন অধিপতিকে এখনো আমরা সহজে প্ৰত্যক্ষ করিতে পারি নাই। যদি অকস্মাৎ কোনো বৃহৎ ঘটনায়, কোনো মহান আবেগের ঝড়ে পর্দা একবার একটু উড়িয়া যায়। তবে এই দেবাধিষ্ঠিত দেশের মধ্যে হঠাৎ দেখিতে পাইব, আমরা কেহই স্বতন্ত্র নহি, বিচ্ছিন্ন নাহি- দেখিতে পাইব, যিনি যুগযুগান্তর হইতে আমাদিগকে এই সমুদ্রবিধৌত হিমাদ্রি-অধিরাজিত উদার দেশের মধ্যে এক ধনধান্য, এক সুখদুঃখ, এক বিরাট প্রকৃতির মাঝখানে রাখিয়া নিরস্তর এক করিয়া তুলিতেছেন, সেই দেশের দেবতা দুর্জেয়, তাহাকে কোনোদিন কেহই অধীন করে নাই, তিনি ইংরেজি স্কুলের ছাত্র নহেন, তিনি ইংরেজ রাজার প্রজা নহেন, আমাদের বহুতর দুৰ্গতি তাহাকে স্পর্শও করিতে পারে নাই, তিনি প্রবল, তিনি চিরজাগ্ৰত— ইহার এই সহজমুক্ত স্বরূপ দেখিতে পাইলে তখনই আনন্দের প্রাচুর্যবেগে আমরা অনায়াসেই পূজা করিব, ত্যাগ করিব, আত্মসমপণ করিব, কোনো উপদেশের অপেক্ষা থাকিবে না। তখন দুৰ্গম পথকে পরিহার করিব না, তখন পরের প্রসাদকেই জাতীয় উন্নতিলাভের চরম সম্বল মনে করাকে পরিহাস করিব এবং অপমানের মূল্যে আশু ফললাভের উষ্ণুবৃত্তিকে অন্তরের সহিত অবজ্ঞা করিতে পারিব। আজ একটি আকস্মিক ঘটনায় সমস্ত বাঙালিকে একই বেদনায় আঘাত করাতে আমরা যেন ক্ষণকালের জন্যও আমাদের এই স্বদেশের অন্তর্যামী দেবতার আভাস পাইয়াছি। সেইজন্য, যাহারা কোনোদিন চিন্তা করিত না তাহারা চিন্তা করিতেছে, যাহারা পরিহাস করিত তাহারা স্তব্ধ হইয়াছে, যাহারা কোনো মহান সংকল্পের দিকে তাকাইয়া কোনোরূপ ত্যাগাস্বীকার করিতে জনিত না তাহারাও যেন কিছু অসুবিধা ভোগ করিবার জন্য উদ্যম অনুভব করিতেছে এবং যাহারা প্ৰত্যেক কথাতেই পরের দ্বারে ছুটিতে ব্যগ্ৰ হইয়া উঠিত তাহারাও কিঞ্চিৎ দ্বিধার সহিত নিজের শক্তি সন্ধান করিতেছে। একবার এই আশ্চর্য ব্যাপারটা ভালো করিয়া মনের মধ্যে অনুভব করিয়া দেখুন। ইতিপূর্বে রাজার কোনো অপ্ৰিয় ব্যবহারে বা কোনো অনভিমত আইনে আঘাত পাইয়া আমরা অনেকবার অনেক কলাকৌশল, অনেক কোলাহল, অনেক সভা আহবান করিয়াছি ; কিন্তু আমাদের অন্তঃকরণ বল পায় নাই, আমরা নিজের চেষ্টাকে নিজে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি নাই, এইজন্য সহস্ৰ অত্যুক্তিদ্বারাও রাজার প্রত্যয় আকর্ষণ করিতে পারি নাই, দেশের ঔদাসীন্য দূর করিতে পারি নাই। আজ আসন্ন বঙ্গবিভাগের উদযোগ বাঙালির পক্ষে পরম শোকের কারণ হইলেও এই শোক আমাদিগকে নিরুপায় অবসাদে অভিভূত করে নাই। বস্তুত, বেদনার মধ্যে আমরা একটা আনন্দই অনুভব করিতেছি। আনন্দের কারণ, এই বেদনার মধ্যে আমরা নিজেকে অনুভব করিতেছি— পরকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি না। আনন্দের কারণ, আমরা আভাস পাইয়াছি আমাদের নিজের একটা শক্তি আছে- সেই শক্তির প্রভাবে আজ আমরা ত্যাগ করিবার, দুঃখ ভোগ করিবার পরম অধিকার লাভ করিয়াছি। আজ আমাদের বালকেরাও বলিতেছে, পরিত্যাগ করো বিদেশের বেশভুষা, বিদেশের বিলাস পরিহার করো।-- সে কথা শুনিয়া বৃদ্ধেরাও তাহাদিগকে ভৎসনা করিতেছে না, বিজ্ঞেরাও তাহাদিগকে পরিহাস করিতেছে না ; এই কথা নিঃসংকোচে বলিবার এবং এই কথা নিস্তব্ধ হইয়া শুনিবার বল আমরা কোথা হইতে পাইলাম ? সুখেই হউক আর দুঃখেই হউক, সম্পদেই হউক আর বিপদেই হউক, হৃদয়ে হৃদয়ে যথার্থভাবে মিলন হইলেই র্যাহার আবির্ভাব আর মুহুর্তকাল গোপন থাকে না। তিনি আমাদিগকে বিপদের দিনে এই বল দিয়াছেন, দুঃখের দিনে এই আনন্দ দিয়াছেন। আজ দুর্যোগের রাত্রে যে বিদ্যুতের আলোক চকিত