পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

とbr8 রবীন্দ্র-রচনাবলী নিজেকে ভুলইয়া রাখিবার দিন আর আমাদের নাই। বড়ো দুঃখে আজ আমাদিগকে বুঝিতে হইয়াছে যে, আমাদের নিজের সহায় আমরা নিজেরা ছাড়া আর কেহ নাই। এই সহজ কথা যাহারা সহজেই না বুঝে, অপমান তাহাদিগকে বুঝায়, নৈরাশ্য তাহাদিগকে বুঝায়। তাই আজ দায়ে পড়িয়া আমাদিগকে বুঝিতে হইয়াছে যে ! ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ।। আজ আসন্নবিচ্ছেদশঙ্কিত বঙ্গভূমিতে দাড়াইয়া বাঙালি এ কথা সুস্পষ্ট বুঝিয়াছে যে, যেখানে স্বার্থের অনৈক্য, যেখানে শ্রদ্ধার অভাব, যেখানে রিক্ত ভিক্ষার ঝুলি ছাড়া আর কোনোই বল বা সম্বল নাই, সেখানে ফললাভের আশা কেবল যে বিড়ম্বনা তাহা নহে, তাহী লাঞ্ছনার একশেষ। এই আঘাত আবার একদিন হয়তো সহ্য হইয়া যাইবে— অপমানে যাহা শিখিয়াছি তাহা হয়তো আবার ভুলিয়া গিয়া আবার গুরুতর অপমানের জন্য প্রস্তুত হইব। যে দুর্বল নিশ্চেষ্ট তাহার। ইহাই দুৰ্ভাগ্য- দুঃখ তাহাকে দুঃখই দেয়, শিক্ষা দেয় না। আজ সেই শঙ্কায় ব্যাকুল হইয়া সময় থাকিতে এই দুঃসময়ের দান গ্ৰহণ করিবার জন্য আমরা একত্র হইয়াছি। কোথায় আমরা আপনারা আছি, কোথায় আমাদের শক্তি এবং কোন দিকে আমাদের অসম্মান ও প্রতিকূলতা, আজ দৈবকৃপায় যদি তাহা আমাদের ধারণা হইয়া থাকে, তবে কেবল তাহাকে ক্ষীণ ধারণার মধ্যে রাখিয়া দিলে চলিবে না। কারণ, শুদ্ধমাত্র ইহাকে মনের মধ্যে রাখিলে ক্ৰমে ইহা কেবল কথার কথা এবং অবশেষে একদিন ইহা বিস্মৃত ও তিরোহিত হইয়া যাইবে । ইহাকে চিরদিনের মতো আমাদিগকে মনে গাঁথিতে এবং কাজে খাটাইতে হইবে। ইহাকে ভুলিলে আমাদের কোনোমতেই চলিবে না- তাহা হইলে আমরা মরিব । কাজে খাটাইতে হইবে । কিন্তু আমরা স্ত্রীলোক – পুরুষের মতো আমাদের কার্যক্ষেত্র বাহিরে বিস্তুত নহে। জানি না, আজিকার দুদিনে আমাদের পুরুষেরা কী কাজ করিতে উদ্যত হইয়াছেন। জানি না, এখনো তাহারা যথার্গ মনের সঙ্গে বলিতে পারিয়াছেন কি না যে— আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিানু, হায়, তাই ভাবি মনে ! যে নিজীবী, যে সহজ পথ খুঁজিয়া আপনাকে ভুলইয়া রাখিতেই চায়, তাহাকে ভুলাইবার জন্য। আশাকে অধিক বেশি ছলনা বিস্তার করিতে হয় না। সে হয়তো এখনো মনে করিতেছে, যদি এখানকার রাজদ্বার হইতে ভিক্ষুককে তাড়া খাইতে হয়, তবে ভিক্ষার বুলি ঘাড়ে করিয়া সমুদ্রপারে যাইতে হইবে । সমুদ্রের এ পারেই কি আর ও পারেই কি, অনন্যাশরণ কঙাল সেই একই চরণ আশ্রয় করিয়াছে। কিন্তু এ দশা আমাদের পুরুষদের মধ্যে সকলের নহে— তাহাদের বহুদিনের বিশ্বাস-ক্ষেত্রে ভূমিকম্প উপস্থিত হইয়াছে, তাহাদের ভক্তি টলিয়াছে, তাহাদের আশা খিলানে-খিলানে ফাটিয়া ফাক হইয়া গেছে— এখন তাহারা ভাবিতেছেন, ইহার চেয়ে নিজের দীনহীন কুটির আশ্রয় করাও নিরাপদ । এখন তাই সমস্ত দেশের মধ্যে নিজের শক্তিকে অবলম্বন করিবার জন্য একটা মৰ্মভেদী আহবান উঠিয়াছে । এই আহবানে পুরুষেরা কে কী ভাবে সাড়া দিবেন তাহা জানি না, কিন্তু আমাদের অন্তঃপুরেও কি এই আহবান প্রবেশ করে নাই ? আমরা কি আমাদের মাতৃভূমির কন্যা নাহি ? দেশের অপমান কি আমাদের অপমান নহে? দেশের দুঃখ কি আমাদের গৃহপ্ৰাচীরের পাষাণ ভেদ করিতে পরিবে না ? ভগিনীগণ, আপনারা হয়তো কেহ কেহ জিজ্ঞাসা করিবেন, আমরা স্ত্রীলোক, আমরা কী করিতে পারি— দুঃখের দিনে নীরবে অশ্রুবর্ষণ করাই আমাদের সম্বল । এ কথা আমি স্বীকার করিতে পারিব না। আমরা যে কী না করিতেছি। তাই দেখুন। আমরা পরনের শাড়ি কিনিতেছি বিলাত হইতে, আমাদের অনেকের ভূষণ জোগাইতেছে। হ্যামিল্টন, আমাদের গৃহসজ্জা বিলাতি দোকানের, আমরা শয়নে স্বপনে বিলাতের দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া আছি। আমরা