পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VSO রবীন্দ্র-রচনাবলী আছে— আমরা গরিবের যোগ্য বিদ্যালয় যদি নিজে গড়িয়া তুলিতে পারি। তবে সেই আমাদের সম্পদ। যে ভালো আমার আয়ত্ত ভালো নহে সে ভালোকে আমার মনে করাই মানুষের পক্ষে বিষম বিপদ । অল্পদিন হইল একজন বাঙালি ডেপুটি-ম্যাজিষ্ট্রেট দেশীয় রাজ্যশাসনের প্রতি নিতান্ত অবজ্ঞা প্ৰকাশ করিতেছিলেন— তখন স্পষ্টই দেখিতে পাইলাম। তিনি মনে করিতেছেন, ব্রিটিশ-রাজ্যের সুব্যবস্থা সমস্তই যেন তাহাদেরই সুব্যবস্থা ; তিনি যে ভারবাহীমাত্র, তিনি যে যন্ত্রী নহেন, যন্ত্রের একটা সামান্য অঙ্গমাত্র, এ কথা যদি তাহার মনে থাকিত তবে দেশীয় রাজ্যব্যবস্থার প্রতি এমন স্পর্ধার সহিত অবজ্ঞা প্ৰকাশ করিতে পারিতেন না । ব্রিটিশ-রাজ্যে আমরা যাহা পাইতেছি। তাহা যে আমাদের নহে, এই ক্ৰমাগতই নূতন নূতন অধিকার প্রার্থনা করিতেছি এবং ভুলিয়া যাইতেছি— অধিকার পাওয়া এবং অধিকারী হওয়া একই কথা নহে । দেশীয় রাজ্যের ভুলত্রুটি-মন্দগতির মধ্যেও আমাদের সাস্তুনার বিষয় এই যে, তাহাতে যেটুকু পায়ে চলিবার লাভ । এই কারণেই আমাদের বাংলাদেশের এই ক্ষুদ্র ত্রিপুররাজ্যের প্রতি উৎসুক দৃষ্টি না মেলিয়া আমি থাকিতে পারি না । এই কারণেই এখানকার রাজ্যব্যবস্থার মধ্যে যে-সকল অভাব ও বিঘ্ন দেখিতে পাই তাহাকে আমাদের সমস্ত বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য বলিয়া জ্ঞান করি । এই কারণেই এখানকার রাজ্যশাসনের মধ্যে যদি কোনো অসম্পূর্ণতা বা শৃঙ্খলার অভাব দেখি তবে তাহা লইয়া স্পর্ধাপূর্বক আলোচনা করিতে আমার উৎসাহ হয় না— আমার মাথা হেঁট হইয়া যায়। এই কারণে, যদি জানিতে পাই তুচ্ছ স্বার্থপরতা আপনার সামান্য লাভের জন্য, উপস্থিত ক্ষুদ্র সুবিধার জন্য, রাজশ্ৰীর মন্দিরভিত্তিকে শিথিল করিয়া দিতে কুষ্ঠিত হইতেছে না, তবে সেই অপরাধকে আমি ক্ষুদ্রব্রাজ্যের একটি ক্ষুদ্র ঘটনা বলিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পাবি না । এই দেশীয় রাজ্যের লজ্জাকেই যদি যথার্থীরাপে আমাদের লজ্জা এবং ইহার গৌরবকেই যদি যথার্থীরাপে আমাদের গৌরব বলিয়া না বুঝি, তবে দেশের সম্বন্ধে আমরা ভুল বুঝিয়াছি। পূর্বেই বলিয়াছি, ভারতীয় প্রকৃতিকেই বীর্যের দ্বারা সবল করিয়া তুলিলে তবেই আমরা যথার্থ উৎকর্ষলাভের আশা করিতে পারিব । ব্রিটিশ-রাজ ইচ্ছা করিলেও এ সম্বন্ধে আমাদিগকে সাহায্য করিতে পারেন না । তাহারা নিজের মহিমাকেই একমাত্ৰ মহিমা বলিয়া জানেন— এই কারণে, ভালোমনেও তাহারা আমাদিগকে যে শিক্ষা দিতেছেন তাহাতে আমরা স্বদেশকে অবজ্ঞা করিতে শিখিতেছি । আমাদের মধ্যে র্যাহারা পেট্রিয়ট বলিয়া বিখ্যাত তাহাদের অনেকেই এই অবজ্ঞাকারীদের মধ্যে অগ্রগণ্য । এইরূপে র্যাহারা ভারতকে অস্তরের সহিত অবজ্ঞা করেন তাহারাই ভারতকে বিলাত করিবার জন্য উৎসুক- সৌভাগ্যক্রমে তাহাদের এই অসম্ভব। আশা কখনোই সফল হইতে পরিবে: ୩ । আমাদের দেশীয় রাজ্যগুলি পিছাইয়া পড়িয়া থাকুক। আর যাহাই হউক, এইখানেই স্বদেশের যথার্থ স্বরূপকে আমরা দেখিতে চাই । বিকৃত-অনুকৃতির মহামারী এখানে প্ৰবেশলাভ করিতে না পারুক, এই আমাদের একান্ত আশা । ব্রিটিশ-রাজি আমাদের উন্নতি চান, কিন্তু সে উন্নতি ব্রিটিশ মতে হওয়া চাই । সে অবস্থায় জলপদ্মের উন্নতিপ্ৰণালী স্থলপদ্মে আরোপ করা হয় । কিন্তু দেশীয় রাজ্যে স্বভাবের অব্যাহত নিয়মে দেশ উন্নতিলাভের উপায় নির্ধারণা করিবে, ইহাই আমাদের কামনা | ইহার কারণ এ নয় যে, ভারতের সভ্যতাই সকল সভ্যতার শ্রেষ্ঠ । যুরোপের সভ্যতা মানবজাতিকে যে সম্পত্তি দিতেছে তাহা যে মহামূল্য, এ সম্বন্ধে সন্দেহ প্ৰকাশ করা ধৃষ্টতা । অতএব, যুরোপীয় সভ্যতাকে নিকৃষ্ট বলিয়া বর্জন করিতে হইবে এ কথা আমার বক্তব্য নহেতাহা আমাদের পক্ষে অস্বাভাবিক বলিয়াই অসাধ্য বলিয়াই স্বদেশী আদর্শের প্রতি আমাদের মন দিতে হইবে— উভয় আদর্শের তুলনা করিয়া বিবাদ করিতে আমার প্রবৃত্তি নাই, তবে এ কথা