পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ど S আত্মশক্তি বলিতেই হইবে যে উভয় আদৰ্শই মানবের পক্ষে অত্যাবশ্যক । সেদিন এখানকার কোনো ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন যে, গবমেন্ট আর্ট স্কুলের আমি তাহাতে উত্তর করিয়াছিলাম যে, ভালোই হইয়াছে। তাহার কারণ এ নয় যে, বিলাতি চিত্ৰকলা উৎকৃষ্ট সামগ্ৰী নহে। কিন্তু সেই চিত্ৰকলাকে এত সস্তায় আয়ত্ত করা চলে না। আমাদের দেশে সেই চিত্রকলার যথার্থ আদর্শ পাইব কোথায় ? দুটাে লক্ষৌ-ঠুংরি ও ‘হিলিমিলি পনিয়া’ শুনিয়া যদি কোনো বিলাতবাসী ইংরেজ ভারতীয় সংগীতবিদ্যা আয়ত্ত করিতে ইচ্ছা করে, তবে বন্ধুর কর্তব্য তাহাকে নিরস্ত করা। বিলাতি বাজারের কতকগুলি সুলভ আবর্জনা এবং সেইসঙ্গে দুটি একটি ভালো ছবি চোখের সামনে রাখিয়া আমরা চিত্ৰবিদ্যার যথার্থ আদর্শ কেমন করিয়া পাইব ? এই উপায়ে আমরা যেটুকু শিখি তাহা যে কত নিকৃষ্ট তাহাও ঠিকমত বুঝিবার উপায় আমাদের দেশে নাই। যেখানে একটা জিনিসের আগাগোড়া নাই, কেবল কতকগুলা খাপছাড়া দৃষ্টান্ত আছে মাত্র, সেখানে সে জিনিসের পরিচয়লাভের চেষ্টা করা বিড়ম্বনা। এই অসম্পূর্ণ শিক্ষায় আমাদের দৃষ্টি নষ্ট করিয়া দেয়— পরের দেশের ভালোটা তো শিখিতেই পারি না, নিজের দেশের ভালোটা দেখিবার শক্তি চলিয়া যায়। আর্ট স্কুলে ভর্তি হইয়াছি, কিন্তু আমাদের দেশে শিল্পকলার আদর্শ যে কী তাহা আমরা জানিই না। যদি শিক্ষার দ্বারা ইহার পরিচয় পাইতাম তবে যথার্থ একটা শক্তিলাভ করিবার সুবিধা হইত। কারণ, এ আদর্শ দেশের মধ্যেই আছে— একবার যদি আমাদের দৃষ্টি খুলিয়া যায়। তবে ইহাকে আমাদের সমস্ত দেশের মধ্যে, থালায়, ঘটিতে, বাটিতে, ঝুড়িতে, চুপড়িতে, মন্দিরে, মঠে, বসনে, ভূষণে, পটে, গৃহভিত্তিতে, নানা-অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-পরিপূর্ণ একটি সমগ্ৰ মর্তিরূপে দেখিতে পাইতাম ; ইহার প্রতি আমাদের পারিতাম | এই কারণে, আমাদের শিক্ষার অবস্থায় বিলাতি চিত্রের মোহ জোর করিয়া ভাঙিয়া দেওয়া ভালো। নহিলে নিজের দেশে কী আছে তাহা দেখিতে মন যায় না— কেবলই অবজ্ঞায় অন্ধ হইয়া যে আমরা দেখিয়াছি, জাপানের একজন সুবিখ্যাত চিত্ররসজ্ঞ পণ্ডিত এ দেশের কীটদষ্ট কয়েকটি পটের ছবি দেখিয়া বিস্ময়ে পুলকিত হইয়াছেন— তিনি একখানি পট এখান হইতে লইয়া গেছেন, সেখানি কিনিবার জন্য জাপানের অনেক গুণজ্ঞ তাহাকে অনেক মূল্য দিতে চাহিয়াছিল, কিন্তু তিনি বিক্রয় করেন নাই । আমরা ইহাও দেখিয়াছি, য়ুরোপের বহুতর রসজ্ঞ ব্যক্তি আমাদের অখ্যাত দোকানবাজার ঘাটিয়া মলিন ছিন্ন কাগজের চিত্ৰপট বহুমূল্য সম্পদের ন্যায় সংগ্ৰহ করিয়া লইয়া যাইতেছেন। সে-সকল চিত্র দেখিলে আমাদের আর্ট স্কুলের ছাত্ৰগণ নাসাকৃঞ্চন করিয়া থাকেন। ইহার কারণ কী ? ইহার কারণ এই, কলাবিদ্যা যথার্থভাবে যিনি শিখিয়াছেন তিনি বিদেশের অপরিচিত রীতির চিত্রের সৌন্দর্যও ঠিকভাবে দেখিতে পান— তাহার একটি শিল্পদূষ্টি জন্মে। আর, যাহারা কেবল নকল করিয়া শেখে তাহারা নকলের বাহিরে কিছুই দেখিতে পায় না। আমরা যদি নিজের দেশের শিল্পকলাকে সমগ্রভাবে যথার্থভাবে দেখিতে শিখিতাম, তবে আমাদের সম্মুখে উদঘাটিত হইয়া যাইত। কিন্তু বিদেশী শিল্পের নিতান্ত অসম্পূর্ণ শিক্ষায়, আমরা যাহা পাই নাই তাহাকে পাইয়াছি বলিয়া মনে করি, যাহা পরের তহবিলেই রহিয়া গেছে তাহাকে নিজের পিয়ের লোটি ছদ্মনামধারী বিখ্যাত ফরাসি ভ্ৰমণকারী ভারতবর্ষে ভ্ৰমণ করিতে আসিয়া আমাদের দেশের রাজনিকেতনগুলিতে বিলাতি আসবাবের ছড়াছডি দেখিয়া হতাশ হইয়া গেছেন। তিনি বুঝিয়াছেন যে, বিলাতি আসবাবখানার নিতান্ত ইতরশ্রেণীর সামগ্ৰীগুলি ঘরে সাজাইয়া আমাদের