পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

محے নববষ বোলপুর, শান্তিনিকেতন আশ্রমে পঠিত অধুনা আমাদের কাছে কর্মের গৌরব অত্যন্ত বেশি। হাতের কাছে হউক, দূরে হউক, দিনে হউক, দিনের অবসানো হউক, কর্ম করিতে হইবে। কী করি, কী করি, কোথায় মরিতে হইবে, কোথায় আত্মবিসর্জন করিতে হইবে, ইহাই অশান্তচিত্তে আমরা খুজিতেছি। যুরোপে লাগাম-পরা অবস্থায় মরা একটা গৌরবের কথা। কাজ, অকাজ, অকারণ কাজ, যে উপায়েই হউক, জীবনের শেষ নিমেষপাত পর্যন্ত ছুটাছুটি করিয়া, মাতামতি করিয়া মরিতে হইবে! এই কর্ম-নাগরদোলার ঘূর্ণিনেশা যখন এক-একটা জাতিকে পাইয়া বসে তখন পৃথিবীতে আর শান্তি থাকে না। তখন দুৰ্গম হিমালয়শিখরে যে লোমশ ছাগ এতকাল নিরুদবেগে জীবন বহন করিয়া আসিতেছে তাহারা অকস্মাৎ শিকারির গুলিতে প্রাণত্যাগ করিতে থাকে ; বিশ্বস্তচিত্ত সীল এবং পেঙ্গুয়িন পক্ষী এতকাল জনশূন্য তুষারমরুর মধ্যে নিবিরোধে প্ৰাণধারণ করিবার সুখটুকু ভোগ করিয়া আসিতেছিল, অকলঙ্ক শুভ্ৰ নীহার হঠাৎ সেই নিরীহ প্ৰাণীদের রক্তে রঞ্জিত হইয়া উঠে। কোথা হইতে বণিকের কামান শিল্পনিপুণ প্রাচীন চীনের কণ্ঠের মধ্যে অহিফেনের পিণ্ড বর্ষণ করিতে থাকে, এবং আফ্রিকার নিভৃত অরণ্যসমাচ্ছন্ন কৃষ্ণত্ব সভ্যতার বজে বিদীর্ণ হইয়া আর্তস্বরে প্রাণত্যাগ করে। এখানে আশ্রমে নির্জন প্রকৃতির মধ্যে স্তব্ধ হইয়া বসিলে অন্তরের মধ্যে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, হওয়াটাই জগতের চরম আদর্শ, করাটা নহে। প্রকৃতিতে কর্মের সীমা নাই, কিন্তু সেই কর্মটাকে অন্তরালে রাখিয়া সে আপনাকে হওয়ার মধ্যে প্রকাশ করে। প্রকৃতির মুখের দিকে যখনই চাই, দেখি সে অক্লিষ্ট অক্লান্ত, যেন সে কাহার নিমন্ত্রণে সাজগোজ করিয়া বিস্তীর্ণ নীলাকাশে আরামে আসন গ্ৰহণ করিয়াছে। এই নিখিলংগৃহিণীর রান্নাঘর কোথায়, টেকিশালা কোথায়, কোন ভাণ্ডারের স্তরে স্তরে ইহার বিচিত্ৰ আকারের ভাণ্ড সাজানো রহিয়াছে ? ইহার দক্ষিণহস্তের হাতাবেড়িগুলিকে আভরণ বিলিয়া ভ্ৰম হয়, ইহার কাজকে লীলার মতো মনে হয়, ইহার চলাকে নৃত্য এবং চেষ্টাকে ঔদাসীন্যের মতো জ্ঞান হয়। ঘূর্ণ্যমান চক্রগুলিকে নিম্নে গোপন করিয়া, স্থিতিকেই গতির উর্ধের্ব রাখিয়া, প্রকৃতি আপনাকে নিত্যকাল প্ৰকাশমান রাখিয়াছে— উর্ধবশ্বাস কর্মের বেগে নিজেকে অস্পষ্ট এবং সঞ্চীয়মান কর্মের স্তুপে নিজেকে আচ্ছন্ন করে নাই। এই কর্মের চতুদিকে অবকাশ, এই চাঞ্চল্যকে ধ্রুবশান্তির দ্বারা মণ্ডিত করিয়া রাখা, প্রকৃতির চিরনবীনতার ইহাই রহস্য। কেবল নবীনতা নহে, ইহাই তাহার বল। ভারতবর্ষ তাহার তপ্ততাম্র আকাশের নিকট, তাহার শুষ্ক৷ ধূসর প্রান্তরের নিকট, তাহার জুলজটামণ্ডিত বিরাট মধ্যাহ্নের, নিকট, তাহার নিকষকৃষ্ণ নিঃশব্দ রাত্রির নিকট হইতে, এই উদার |ান্তি, এই বিশাল স্তব্ধতা আপনার অন্তঃকরণের মধ্যে লাভ করিয়াছে। ভারতবর্ষ কর্মের ক্রীতদাস নহে । সকল জাতির স্বভাবগত আদর্শ এক নয়- তাহা লইয়া ক্ষোভ করিবার প্রয়োজন দেখি না। ভারতবর্ষ মানুষকে লঙ্ঘন করিয়া কর্মকে বড়ো করিয়া তোলে নাই। ফলাকাঙক্ষাহীন কর্মকে মাহাত্ম্য দিয়া সে বস্তুত কর্মকে সংযত করিয়া লইয়াছে। ফলের আকাঙক্ষা উপড়াইয়া ফেলিলে কর্মের বিষদাঁত