পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ー ○○ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী কাজকে সকলের আয়ত্ত করা, অন্নকে সকলের পক্ষে সুলভ করা প্ৰাচ্য আদর্শ। এ কথা আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে । আমোদ বল, শিক্ষা বল, হিতকর্ম বল, সকলকেই একান্ত জটিল ও দুঃসাধ্য করিয়া তুলিলে, কাজেই সম্প্রদায়ের হাতে ধরা দিতে হয় । তাহাতে কর্মের আয়োজন ও উত্তেজনা উত্তরোত্তর এতই বৃহৎ হইয়া উঠে যে, মানুষ আচ্ছন্ন হইয়া যায়। প্রতিযোগিতার নিষ্ঠুর তাড়নায় কর্মজীবীরা যন্ত্রের অধম হয়। বাহির হইতে সভ্যতার বৃহৎ আয়োজন দেখিয়া স্তম্ভিত হই— তাহার তলদেশে যে নিদারুণ নরমেধযজ্ঞ অহােরাত্র অনুষ্ঠিত হইতেছে তাহা গোপনে থাকে। কিন্তু বিধাতার কাছে তাহা গোপন নহে— মাঝে মাঝে সামাজিক ভূমিকম্পে তাহার পরিণামের সংবাদ পাওয়া যায়। যুরোপে বড়ো দল ছোটো দলকে পিষিয়া ফেলে, বড়ো টাকা ছোটো টাকাকে উপবাসে ক্ষীণ করিয়া আনিয়া শেষকালে বটিকার মতো চোখ বুজিয়া গ্ৰাস করিয়া ফেলে। কাজের উদ্যমকে অপরিমিত বাড়াইয়া তুলিয়া, কাজগুলাকে প্ৰকাণ্ড করিয়া কাজে কাজে লড়াই বাধাইয়া দিয়া, যে অশান্তি ও অসন্তোষের বিষ উন্মথিত হইয়া উঠে, আপাতত সে আলোচনা থাক । আমি কেবল ভাবিয়া দেখিতেছি, এই-সকল কৃষ্ণধূমশ্বসিত দানবীয় কারখানাগুলার ভিতরে বাহিরে চারি দিকে মানুষগুলাকে যে ভাবে তাল পাকাইয়া থাকিতে হয়, তাহাতে তাহাদের নির্জনত্বের সহজ অধিকার, একাকিত্বের আবরুটুকু থাকে না। না থাকে স্থানের অবকাশ, না থাকে কালের অবকাশ, না থাকে ধ্যানের অবকাশ। এইরূপে নিজের সঙ্গ নিজের কাছে অত্যন্ত অনভ্যস্ত হইয়া পড়াতে, কাজের একটু ফাক হইলেই মদ খাইয়া, প্রমোদে মাতিয়া, বলপূর্বক নিজের হাত হইতে নিস্কৃতি পাইবার চেষ্টা ঘটে । নীরব থাকিবার, স্তব্ধ থাকিবার, আনন্দে থাকিবার সাধ্য আর কাহারও থাকে না। যাহারা শ্রমজীবী তাহদের এই দশা। যাহারা ভোগী তাহারা ভোগের নব নব উত্তেজনায় ক্লান্ত । নিমন্ত্রণ খেলা নৃত্য ঘোড়দৌড় শিকার ভ্রমণের ঝড়ের মুখে শুষ্কপত্রের মতো দিনরাত্রি তাহারা নিজেকে আবর্তিত করিয়া বেড়ায়। ঘূর্ণাগতির মধ্যে কেহ কখনো নিজেকে এবং জগৎকে ঠিকভাবে দেখিতে পায় না, সমস্তই অত্যন্ত ঝাপসা দেখে। যদি এক মুহুর্তের জন্য তাহার প্রমোদচক্ৰ থামিয়া যায়, তবে সেই ক্ষণকালের জন্য নিজের সহিত সাক্ষাৎকার, বৃহৎ জগতের সহিত মিলনলাভ, তাহার পক্ষে অত্যন্ত দুঃসহ বোধ হয় । ভারতবর্ষ ভোগের নিবিড়তাকে আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশীর মধ্যে ব্যাপ্ত করিয়া লঘু করিয়া দিয়াছে, এবং কর্মের জটিলতাকেও সরল করিয়া আনিয়া মানুষে মানুষে বিভক্ত করিয়া দিয়াছে। ইহাতে ভোগে কর্মে এবং ধ্যানে প্রত্যেকেরই মনুষ্যত্ব চর্চার যথেষ্ট অবকাশ থাকে। ব্যবসায়ী— সেও মন দিয়া কথকতা শোনে, ক্রিয়াকর্ম করে ; শিল্পী— সেও নিশ্চিন্তমনে সুর করিয়া রামায়ণ পড়ে। এই অবকাশের বিস্তারে গৃহকে, মনকে, সমাজকে কলুষের ঘনবাস্প হইতে অনেকটা পরিমাণে নির্মল করিয়া রাখে, দূষিত বায়ুকে বদ্ধ করিয়া রাখে না, এবং মলিনতার আবর্জনাকে একেবারে গায়ের পাশেই জমিতে দেয় না। পরস্পরের কড়াকড়িতে ঘেঁষাৰ্ঘেষিতে যে রিপুর দাবানল জ্বলিয়া উঠে, ভারতবর্ষে তাহা প্রশমিত থাকে । ভারতবর্ষের এই একাকী থাকিয়া কাজ করিবার ব্ৰতকে যদি আমরা প্ৰত্যেকে গ্ৰহণ করি, তবে এবারকার নববর্ষ আশিসবর্ষণে ও কল্যাণশস্যে পরিপূর্ণ হইবে। দল বাধিবার, টাকা জুটাইবার ও সংকল্পকে স্ফীত করিবার জন্য সুচিরকাল অপেক্ষা না করিয়া যে যেখানে, আপনার গ্রামে, প্ৰান্তরে, পল্লীতে, গৃহে, স্থিরশান্তচিত্তে, ধৈর্যের সহিত, সন্তোষের সহিত পুণ্যকর্ম, মঙ্গলকর্ম সাধন করিতে আরম্ভ করি ; আড়ম্বরের অভাবে ক্ষুব্ধ না হইয়া, দরিদ্র আয়োজনে কুষ্ঠিত না হইয়া, দেশীয় ভাবে করতালিবর্ষণের দিকে উর্ধর্বমুখে তাকাইয়া না থাকি- তবে ভারতবর্ষের ভিতরকার যথার্থ বলে আমরা বলী হইব। বাহির হইতে আঘাত পাইতে পারি, বল পাইতে পারি না ; নিজের বল ছাড়া বল