পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

محی ভারতবর্ষ। ー ○○ করিয়াছে। নূতনত্বের মধ্যে চিরপুরাতনকে অনুভব করিলে তবেই আমেয় যৌবনসমুদ্রে আমাদের জীর্ণ জীবন স্নান করিতে পায়। আজিকার এই নববর্ষের মধ্যে ভারতের বহুসহস্ৰ পুরাতন বর্ষকে উপলব্ধি করিতে পারিলে তবেই আমাদের দুর্বলতা, আমাদের লজ্জা, আমাদের লাঞ্ছনা, আমাদের দ্বিধা দূর হইয়া যাইবে । ধার-করা ফুলপাতায় গাছকে সাজাইলে তাহা আজ থাকে, কাল থাকে না। সেই নূতনত্বের অচিরপ্রাচীনতা ও বিনাশ কেহ নিবারণ করিতে পারে না। নবাবল নবাসৌন্দর্য আমরা যদি অন্যত্র হইতে ধার করিয়া লইয়া সাজিতে যাই, তবে দুই দণ্ড বাদেই তাহা কদৰ্য্যতার মালাররূপে আমাদের ললাটকে উপহাসিত করিবে ; ক্রমে তাহা হইতে পুষ্পপত্র ঝরিয়া গিয কেবল বন্ধনরজিজুটুকুই পড়ে, বিদেশের শিক্ষা রীতিনীতি আমাদের মনে দেখিতে দেখিতে নিজীব ও নিম্বফল হয়— কারণ, তাহার পশ্চাতে সুচিরকালের ইতিহাস নাই— তাহা অসংলগ্ন, অসংগত, তাহার শিকড় ছিন্ন। আদ্যকার নববর্ষে আমরা ভারতবর্ষের চিরপুরাতন হইতে আমাদের নবীনতা গ্রহণ করিব, সায়াহ্নে যখন বিশ্রামের ঘণ্টা বাজিবে তখনো তাহা ঝরিয়া পড়িবে না— তখন সেই অম্লানগৌরব মাল্যখিনি আশীর্বাদের সহিত আমাদের পুত্রের ললাটে বাধিয়া দিয়া তাহাকে নিৰ্ভয়চিত্তে সবলহািদয়ে বিজয়ের পথে প্রেরণ করিব। জয় হইবে, ভারতবর্ষেরই জয় হইবে। যে ভারত প্ৰাচীন, যাহা প্রচ্ছন্ন, যাহা বৃহৎ, যাহা উদার, যাহা কহিতেছি, আস্ফালন করিতেছি, আমরা বর্ষে বর্ষে— “মিলি মিলি যাওব সাগরলহরী-সমান” । তাহাতে নিস্তব্ধ সনাতন ভারতের ক্ষতি হইবে না। ভস্মাচ্ছন্ন মৌনী ভারত চতুষ্পপথে মৃগচম পাতিয়া বসিয়া আছে ; আমরা যখন আমাদের সমস্ত চটুলতা সমাধা করিয়া পুত্রকন্যাগণকে কোটি-ফ্রক পরাইয়া দিয়া বিদায় হইব, তখনো সে শান্তচিত্তে আমাদের পৌত্রদের জন্য প্ৰতীক্ষা করিয়া থাকিবে । সে প্ৰতীক্ষা ব্যর্থ হইবে না, তাহারা এই সন্ন্যাসীর সম্মুখে করজোড়ে আসিয়া কহিবে ; পিতামহ, আমাদিগকে মন্ত্র Wig তিনি কহিবেন : ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি। তিনি কহিবেন : আনন্দং ব্ৰহ্মণো বিদ্বান ন বিভৌতি কদাচন। (ft:2: S SOS ভারতবর্ষের ইতিহাস ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই, তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্নকাহিনীমাত্র। কোথা হইতে কাহারা আসিল, কাটাকাটি মারামারি পডিয়া গেল, বাপে-ছেলেীয় ভাইয়ে-ভাইয়ে সিংহাসন লইয়া টানাটানি চলিতে লাগিল, একদল যদি বা যায় কোথা হইতে আর-একদল উঠিয়া পড়ে— পাঠান-মোগল পর্তুগীজ-ফরাসি-ইংরাজ সকলে মিলিয়া এই স্বপ্নকে উত্তরোত্তর জটিল করিয়া তুলিয়াছে। কিন্তু এই রক্তবর্ণে রঞ্জিত পরিবর্তমান স্বপ্নদৃশ্যপটের দ্বারা ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করিয়া দেখিলে যথার্থ ভারতবর্ষকে দেখা হয় না। ভারতবাসী কোথায়, এ-সকল ইতিহাস তাহার কোনো উত্তর দেয় না। যেন ভারতবাসী নাই, কেবল যাহারা কাটাকাটি খুনখুনি করিয়াছে তাহারাই আছে। তখনকার দুর্দিনেও এই কাটাকাটি-খুনা খুনিই যে ভারতবর্ষের প্রধানতম ব্যাপার তাহা নহে। ঝড়ের দিনে যে ঝড়ই সর্বপ্রধান ঘটনা, তাহা তাহার গর্জনসত্ত্বেও স্বীকার করা যায় না— সেদিনও সেই ধূলিসমাচ্ছন্ন আকাশের মধ্যে পল্লীর গৃহে গৃহে যে জন্মমৃত্যু-সুখদুঃখের প্রবাহ চলিতে থাকে, তাহা ঢাকা পড়িলেও, মানুষের পক্ষে তাহাই প্ৰধান। কিন্তু বিদেশী পথিকের কাছে এই ঝড়টাই প্ৰধান, এই