পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

a のbr রবীন্দ্র-রচনাবলী পদার্থ থাকে। তবে বিদেশ আমাদিগকে যে আঘাত করিতেছে সেই আঘাতে স্বদেশকেই আমরা নিবিড়তররূপে উপলব্ধি করিব। প্রবাসে নির্বাসনই আমাদের কাছে গৃহের মাহাত্ম্যকে মহত্তম করিয়া তুলিবে। মামুদ ও মহম্মদ ঘোরির বিজয়বার্তার সন তারিখ আমরা মুখস্থ করিয়া পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হইয়াছি, এখন যিনি সমস্ত ভারতবর্ষকে সম্মুখে মূর্তিমান করিয়া তুলিবেন অন্ধকারের মধ্যে দাড়াইয়া সেই ঐতিহাসিককে আমরা আহবান করিতেছি। তিনি তাহার শ্রদ্ধার দ্বারা আমাদের মধ্যে শ্রদ্ধার সঞ্চার করিবেন, আমাদিগকে প্ৰতিষ্ঠা দান করিবেন, আমাদের আত্ম-উপহাস আত্ম-অবিশ্বাস অতি অনায়াসে তিরস্কৃত করিবেন, আমাদিগকে এমন প্রাচীন সম্পদের অধিকারী করিবেন যে পরের ছদ্মবেশে নিজের লজ্জা লুকাইবার আর প্রবৃত্তি থাকিবে না। তখন এ কথা আমরা বুঝিব, পৃথিবীতে ভারতবর্ষের একটি মহৎ স্থান আছে, আমাদের মধ্যে মহৎ আশার কারণ আছে ; আমরা কেবল গ্ৰহণ করিব না, অনুকরণ করিব না, দান করিব, প্রবর্তন করিব, এমন সম্ভাবনা আছে; পলিটিকস এবং শিরোধাৰ্য্য করিয়া দুৰ্গম নির্মল মাহান্ত্র্যের উন্নততম শিখরে অধিরোহণ করিবার জন্য আমাদের ঋষি-পিতামহদের সুগভীর নিদেশ-নির্দেশ প্রাপ্ত হইয়াছি— সে পথে পণ্যভারাক্রান্ত অন্য কোনো পান্থ নাই বলিয়া আমরা ফিরিব না, গ্ৰন্থভারনত শিক্ষকমহাশয় সে পথে চলিতেছেন না বলিয়া লজিত হইব। না। মূল্য না দিলে কোনো মূল্যবান জিনিসকে আপনার করা যায় না। ভিক্ষা করিতে গেলে কেবল খুদকুঁড়া মেলে ; তাহাতে পেট অল্পই ভরে, অথচ জাতিও থাকে না। বিদেশকে যতক্ষণ আমরা কিছু দিতে পারি না, বিদেশ হইতে ততক্ষণ আমরা কিছু লইতেও পারি না ; লইলেও তাহার সঙ্গে আত্মসম্মান থাকে না বলিয়াই তাহা তেমন করিয়া আপনার হয় না, সংকোচে সে অধিকার চিরদিন অসম্পূর্ণ ও অসংগত হইয়া থাকে। যখন গৌরবসহকারে দিব তখন গৌরবসহকারে লইব । হে ঐতিহাসিক, আমাদের সেই দিবার সংগতি কোন প্রাচীন ভাণ্ডারে সঞ্চিত হইয়া আছে তাহা দেখাইয়া দাও, তাহার দ্বার উদঘাটন করো। তাহার পর হইতে আমাদের গ্রহণ করিবার শক্তি বাধাহীন ও অকুষ্ঠিত হইবে, আমাদের উন্নতি ও শ্ৰীবৃদ্ধি অকৃত্রিম ও স্বভাবসিদ্ধ হইয়া উঠিবে। ইংরাজ নিজেকে সর্বত্র প্রসারিত, দ্বিগুণিত, চতুরগুণিত করাকেই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রেয় বলিয়া জ্ঞান করিয়াছে ; পারে না। উপনিষদে অনুশাসন আছে : শ্রদ্ধয়া দেয়াম, অশ্রদ্ধয়া আদেয়াম। শ্রদ্ধার সহিত দিবে, অশ্রদ্ধার সহিত দিবে না। কারণ, শ্রদ্ধার সহিত না দিলে যথার্থ জিনিস দেওয়াই যায় না, বরঞ্চ এমন একটা জিনিস দেওয়া হয় যাহাতে গ্ৰহীতাকে হীন করা হয়। আজকালকার ইংরাজ শিক্ষকগণ দানের দ্বারা সবিদ্রুপে স্মরণ করাইতে থাকেন, “যাহা দিতেছি, ইহার তুল্য তোমাদের কিছুই নাই এবং যাহা লইতেছ। তাহার প্রতিদান দেওয়া তোমাদের সাধ্যের অতীত।" প্ৰত্যহ এই অবমাননার বিষ আমাদের মজার মধ্যে প্ৰবেশ করে, ইহাতে পক্ষাঘাত আনিয়া আমাদিগকে নিরুদ্যম করিয়া দেয়। শিশুকাল হইতেই নিজের নিজত্ব উপলব্ধি করিবার কোনো অবকাশ কোনো সুযোগ পাই নাই। পরিভাষার বানান-বাক্য-ব্যাকরণ ও মতামতের দ্বারা উদভ্ৰান্ত অভিভূত হইয়া আছি— নিজের কোনো শ্রেষ্ঠতার প্ৰমাণ দিতে না পারিয়া মাথা হেঁট করিয়া থাকিতে হয়। ইংরেজের নিজের ছেলেদের শিক্ষাপ্ৰণালী এরূপ নহে— অকসফোর্ড-কেমব্রিজে তাঁহাদের ছেলে কেবল যে গিলিয়া থাকে তাহা নহে, তাহারা আলোক আলোচনা ও খেলা হইতে বঞ্চিত হয় না। অধ্যাপকদের সঙ্গে তাঁহাদের সুদূর কালের সম্বন্ধ নহে। একে তো তাহাদের চতুর্দিগবতী স্বদেশীসমাজ স্বদেশী শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে আপন করিয়া লাইবার জন্য শিশুকাল হইতে সর্বতোভাবে আনুকূল্য করিয়া থাকে, তাহার পরে শিক্ষাপ্রণালী ও অধ্যাপকগণও অনুকূল। আমাদের আদ্যোপােন্ত সমস্তই প্রতিকূল ; যাহা শিখি তাহা প্রতিকুল, যে উপায়ে শিখি তাহা প্রতিকুল, যে শেখায় সেও প্রতিকূল। ইহা সত্ত্বেও যদি আমরা কিছু লাভ করিয়া