পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ܠܹ уSE ভারতবর্ষ। ca চলিয়া যায়। সংসারের সহিত, উপস্থিত আবশ্যকের সহিত কর্মীকে নানাপ্রকারে রফা করিয়া চলিতেই হয় । অতএব যে সমাজে কৰ্ম আছে সেই সমাজেই কর্মকে সংযত রাখিবার বিধান থাকা চাই, অন্ধ কর্মই যাহাতে মনুষ্যত্বের উপর কর্তৃত্ব লাভ না করে এমন সতর্ক পাহারা থাকা চাই। কমিদলকে বরাবর ঠিক পথটি দেখাইবার জন্য, কর্মকোলাহলের মধ্যে বিশুদ্ধ সুরটি বরাবর অবিচলিতভাবে ধরিয়া রাখিবার জন্য, এমন একদলের আবশ্যক যাহারা যথাসম্ভব কর্ম ও স্বাৰ্থ হইতে নিজেকে মুক্ত রাখিবেন । তাহারাই ব্ৰাহ্মণ । এই ব্ৰাহ্মণেরাই যথার্থ স্বাধীন। ইহারাই যথাৰ্থ স্বাধীনতার আদর্শকে নিষ্ঠার সহিত, কাঠিন্যের সহিত সমাজে রক্ষা করেন । সমাজ ইহাদিগকে সেই অবসর, সেই সামর্থ্য, সেই সম্মান দেয়। ইহাদের এই মুক্তি, ইহা সমাজেরই মুক্তি। ইহারা যে সমাজে আপনাকে মুক্তভাবে রাখেন ক্ষুদ্র পরাধীনতায় সে সমাজের কোনো ভয় নাই, বিপদ নাই। ব্ৰাহ্মণ-অংশের মধ্যে সে সমাজ সর্বদা আপনার মনের- আপনার আত্মার স্বাধীনতা উপলব্ধি করিতে পারে । আমাদের দেশের বর্তমান ব্ৰাহ্মণগণ যদি দৃঢ়ভাবে উন্নতভাবে আলুব্ধভাবে সমাজের এই পরমধনটি রক্ষা করিতেন। তবে ব্ৰাহ্মণের অবমাননা সমাজ কখনোই ঘটিতে দিত না এবং এমন কথা কখনোই বিচারকের মুখ দিয়া বাহির হইতে পারিত না যে, ভদ্র ব্ৰাহ্মণকে পাদুকাঘাত করা তুচ্ছ ব্যাপার। বিদেশী হইলেও বিচারক মানী ব্ৰাহ্মণের মান আপনি বুঝিতে পারিতেন। কিন্তু যে ব্ৰাহ্মণ সাহেবের আপিসে নতমস্তকে চাকরি করে, যে ব্ৰাহ্মণ আপনার অবকাশ বিক্রয় করে, আপনার মহান অধিকারকে বিসর্জন দেয়, যে ব্ৰাহ্মণ বিদ্যালয়ে বিদ্যাবণিক, বিচারালয়ে বিচারব্যবসায়ী, যে ব্ৰাহ্মণ পয়সার পরিবর্তে আপনার ব্ৰাহ্মণ্যকে ধিককৃত করিয়াছে— সে আপন বিধান লাইতে যাইব কী বলিয়া ? সে তো সর্বসাধারণের সহিত সমানভাবে মিশিয়া ঘামাক্তকলেবরে কাড়াকড়ি-ঠেলাঠেলির কাজে ভিড়িয়া গেছে। ভক্তির দ্বারা সে ব্রাহ্মণ তো সমাজকে উর্ধের্ব আকৃষ্ট করে না, নিমেই লইয়া যায় । এ কথা জানি কোনো সম্প্রদায়ের প্রত্যেক লোকই কোনো কালে আপনার ধর্মকে বিশুদ্ধভাবে রক্ষা করে না, অনেকে স্বশ্বলিত হয়। অনেকে ব্ৰাহ্মণ হইয়াও ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের ন্যায় আচরণ করিয়াছে, পুরাণে এরূপ উদাহরণ দেখা যায়। কিন্তু তবু যদি সম্প্রদায়ের মধ্যে আদর্শ সজীব থাকে, ধর্মপালনের চেষ্টা থাকে, কেহ আগে যাক কেহ পিছাইয়া পাডুক, কিন্তু সেই পথের পথিক যদি থাকে, যদি এই আদর্শের প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত অনেকের মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায়, তবে সেই চেষ্টার দ্বারা, সেই সাধনার দ্বারা, সেই সফলতাপ্ৰাপ্ত ব্যক্তিদের দ্বারাই সমস্ত সম্প্রদায় সার্থক হইয়া থাকে। আমাদের আধুনিক ব্ৰাহ্মণসমাজের সেই আদৰ্শই নাই! সেইজন্যই ব্ৰাহ্মণের ছেলে ইংরাজি শিখিলেই ইংরাজি কেতা ধরে— পিতা তাহাতে অসন্তুষ্ট হন না। কেন এম। এ-পাস-করা মুখোপাধ্যায়, বিজ্ঞানবিৎ চট্টোপাধ্যায়, যে বিদ্যা পাইয়াছেন তাহা ছাত্রকে ঘরে ডাকিয়া আসন হইয়া বসিয়া বিতরণ করিতে পারেন না ? সমাজকে শিক্ষাঋণে ঋণী করিবার গৌরব হইতে কেন তাহারা নিজেকে ও ব্ৰাহ্মণসমাজকে বঞ্চিত করেন ? তাহারা জিজ্ঞাসা করিবেন, খাইব কী ? যদি কালিয়া-পোলোয়া না খাইলেও চলে, তবে নিশ্চয়ই সমাজ আপনি আসিয়া যাচিয়া খাওয়াইয়া যাইবে । তাহাদের নহিলে সমাজের চলিবে না, পায়ে ধরিয়া সমাজ তাহাদিগকে রক্ষা করিবে। আজ তাহারা বেতনের জন্য হাত পাতেন, সেইজন্য সমাজ রসিদ লইয়া টিপিয়া টিপিয়া তাহাদিগকে বেতন দেয় ও কাঁড়ায় গণ্ডায় তাহাদের কাছ হইতে কাজ আদায় করিয়া লয়। তাহারাও কলের মতো বাধা নিয়মে কাজ করেন ; শ্রদ্ধা দেনও না, শ্রদ্ধা পানও না-উপরন্তু মাঝে মাঝে সাহেবের পাদুকা পৃষ্ঠে বহন করা -রূপ অত্যন্ত তুচ্ছ ঘটনার সুবিখ্যাত উপলক্ষ হইয়া উঠেন।