পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ S N2 রবীন্দ্র-রচনাবলী কিন্তু ক্ষত্ৰিয় উত্তেজনা ও বেতনের অভাব ঘটিলেও যুদ্ধে প্ৰাণ দিতে প্ৰস্তুত থাকে। কারণ, যুদ্ধ সমাজের অত্যাবশ্যক কর্ম, এক সম্প্রদায় যদি নিজের ধর্ম বলিয়াই সেই কঠিন কর্তব্যকে গ্ৰহণ করেন। তবে কর্মের সহিত ধর্ম রক্ষা হয়। দেশ-সুদ্ধ সকলে মিলিয়াই যুদ্ধের জন্য প্ৰস্তুত হইলে মিলিটারিজম এর প্রাবল্যে দেশের গুরুতর অনিষ্ট ঘটে। বাণিজ্য সমাজরক্ষার পক্ষে অত্যাবশ্যক কম। সেই সামাজিক আবশ্যকপালনকে এক সম্প্রদায় যদি আপন সাম্প্রদায়িক ধর্ম, আপন কৌলিক গৌরব বলিয়া গ্রহণ করেন, তবে বণিকবৃত্তি সর্বত্রই পরিব্যাপ্ত হইয়া সমাজের অন্যান্য শক্তিকে গ্ৰাস করিয়া ফেলে না। তা ছাড়া, কমের মধ্যে ধর্মের আদর্শ সর্বদাই জাগ্ৰত থাকে। ধর্ম এবং জ্ঞানার্জন, যুদ্ধ এবং রাজকাৰ্য্য, বাণিজ্য এবং শিল্পচর্চা— সমাজের এই তিন অত্যাবশ্যক কর্ম। ইহার কোনোটাকেই পরিত্যাগ করা যায় না। ইহার প্রত্যেকটিকেই ধর্মগৌরব কুলগৌরব দান করিয়া সম্প্রদায়বিশেষের হস্তে সমপণ করিলে তাহাদিগকে সীমাবদ্ধও করা হয়, অথচ বিশেষ উৎকর্ষসাধনেরও অবসর দেওয়া হয় । কর্মের উত্তেজনাই পাছে কর্তা হইয়া আমাদের আত্মাকে অভিভূত করিয়া দেয়, ভারতবর্ষের এই আশঙ্কা ছিল। তাই ভারতবর্ষে সামাজিক মানুষটি লড়াই করে, বাণিজ্য করে, কিন্তু নিত্যমানুষটি, সমগ্ৰ মানুষটি শুধুমাত্র সিপাই নহে, শুধুমাত্র বণিক নহে। কর্মকে কুলব্রত করিলে কর্মকে সামাজিক ধর্ম করিয়া তুলিলে, তবে কর্মসাধনও হয়, অথচ সেই কৰ্ম আপন সীমা লঙঘন করিয়া, সমাজের সামঞ্জস্য ভঙ্গ করিয়া, মানুষের সমস্ত মনুষ্যত্বকে আচ্ছন্ন করিয়া, আত্মার রাজসিংহাসন অধিকার করিয়া বসে না। যাহারা দ্বিজ তাহাদিগকে এক সময় কর্ম পরিত্যাগ করিতে হয়। তখন তাহারা আর ব্ৰাহ্মণ নহেন, ক্ষত্ৰিয় নহেন, বৈশ্য নহেন— তখন তাহারা নিত্যকালের মানুষ— তখন কর্ম তাহাদের পক্ষে আর ধর্ম নহে, সুতরাং অনায়াসে পরিহার্য। এইরূপে দ্বিজসমাজ বিদ্যা এবং অবিদ্যা উভয়কেই রক্ষা করিয়াছিলেন-- তাহারা বলিয়াছিলেন, অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীরত্ব বিদ্যয়ামৃতমশ্বতে, অবিদ্যার দ্বারা মৃত্যু উত্তীর্ণ হইয়া বিদ্যার দ্বারা অমৃত লাভ করিবে। এই সংসারই মৃত্যুনিকেতন, ইহাই অবিদ্যা— ইহাকে উত্তীৰ্ণ হইতে হইলে ইহার ভিতর দিয়াই যাইতে হয় ; কিন্তু এমনভাবে যাইতে হয়, যেন ইহাই চরম না হইয়া উঠে। কর্মকেই একান্ত প্ৰাধান্য দিলে সংসারই চরম হইয়া উঠে ; মৃত্যুকে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না ; অমৃত লাভ করিবার লক্ষ্যই ভ্ৰষ্ট হয়, তাহার অবকাশই থাকে না। এইজন্যই কর্মকে সীমাবদ্ধ করা, কর্মকে ধর্মের সহিত যুক্ত করা— কর্মকে প্রবৃত্তির হাতে, উত্তেজনার হাতে, কর্মজনিত বিপুল বেগের হাতে, ছাড়িয়া না দেওয়া- এবং এইজন্যই ভারতবর্ষে কর্মভেদ বিশেষ জনশ্রেণীতে নির্দিষ্ট করা | ইহাই আদর্শ। ধর্ম ও কর্মের সামঞ্জস্য রক্ষা করা এবং মানুষের চিত্ত হইতে কর্মের নানা পাশ শিথিল করিয়া তাহাকে এক দিকে সংসারব্ৰতপরায়ণ অন্য দিকে মুক্তির অধিকারী করিবার অন্য কোনো উপায় তো দেখি না। এই আদর্শ উন্নততম আদর্শ, এবং ভারতবর্ষের আদর্শ। এই আদর্শে বর্তমান সমাজকে সাধারণভাবে অধিকৃত ও চালিত করিবার উপায় কী, তাহা আমাদিগকে চিন্তা রুরিতে হইবে। সমাজের সমস্ত বন্ধন ছেদন করিয়া কর্মকে ও প্রবৃত্তিকে উদাম করিয়া তোলা- সেজন্য কাহাকেও চেষ্টা করিতে হয় না। সমাজের সে অবস্থা জড়িত্বের দ্বারা, শৈথিল্যের দ্বারা আপনি আসিতেছে। 皇 বিদেশী শিক্ষার প্রাবলো, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিকূলতায়, এই ভারতবষীয় আদর্শ সত্বর এবং সহজে সমস্ত সমাজকে অধিকার করিতে পরিবে না— ইহা আমি জানি। কিন্তু যুরোপীয় আদর্শ অবলম্বন করাই যে আমাদের পক্ষে সহজ এ দুরাশাও আমার নাই। সর্বপ্রকার আদর্শ পরিত্যাগ করাই সর্বাপেক্ষা সহজ, এবং সেই সহজ পথই আমরা অবলম্বন করিয়াছি। যুরোপীয় সভ্যতার আদর্শ এমন একটা আলগা জিনিস নহে যে, তাহা পাকা ফলটির মতো পাড়িয়া লইলেই কবলের মধ্যে অনায়াসে স্থান পাইতে পারে।