পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ՏԵ- রবীন্দ্র-রচনাবলী আমাদের সমস্ত সমাজ সেই প্রাচীন দ্বিজত্বকে লাভ করিবার জন্য চঞ্চল হইয়া উঠিতেছে, প্রত্যহ তাহার পরিচয় পাইয়া মনে আশার সঞ্চার হইতেছে। এক সময় আমাদের হিন্দুত্ব গোপন করিবার, ফিরিয়াছি ও চৌরঙ্গি-অঞ্চলের দেউড়িতে হাজির দিয়াছি। আজ যদি আপনাদিগকে ব্ৰাহ্মণ ক্ষত্ৰিয় পৈতৃক গৌরবে গৌরবান্বিত করিয়াই মহত্ত্বলাভ করিতে ইচ্ছা করিয়া থাকি, তবে তো আমাদের আনন্দের দিন। আমরা ফিরিঙ্গি হইতে চাই না, আমরা দ্বিজ হইতে চাই। ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ইহাতে র্যাহারা বাধা দিয়া অনর্থক কলহ করিতে বসেন, তর্কের ধুলায় ইহার সুদূরব্যাপী সফলতা র্যাহারা না দেখিতে পান, বৃহৎ ভাবের মহত্ত্বের কাছে আপনাদের ক্ষুদ্র পাণ্ডিত্যের ব্যর্থ বাদবিবাদ র্যাহারা লজ্জার সহিত নিরস্ত না করেন, তাহার যে-সমাজের আশ্রয়ে মানুষ হইয়াছেন সেই সমাজেরই শত্রু। দীর্ঘকাল হইতে ভারতবর্ষ আপন ব্ৰাহ্মণ ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য সমাজকে আহবান করিতেছে। য়ুরোপ তাহার জ্ঞানবিজ্ঞানকে বহুতর ভাগে বিভক্ত বিচ্ছিন্ন করিয়া তুলিয়া বিহবল বুদ্ধিতে তাহার মধ্যে সম্প্রতি ঐক্য সন্ধান করিয়া ফিরিতেছে— ভারতবর্ষের সেই ব্ৰাহ্মণ কোথায় যিনি স্বভাবসিদ্ধপ্ৰতিভাবলে অতি অনায়াসেই সেই বিপুল জটিলতার মধ্যে ঐক্যের নিগৃঢ় সরল পথ নির্দেশ করিয়া দিবেন ? সেই ব্ৰাহ্মণকে ভারতবর্ষ নগরকোলাহল ও স্বার্থসংগ্রামের বাহিরে তপোবনে ধ্যানাসনে অধ্যাপকের বেদীতে আহবান করিতেছে— ব্ৰাহ্মণকে তাহার সমস্ত অবমাননা হইতে দূরে আকর্ষণ করিয়া ভারতবর্ষ আপনার অবমাননা দূর করিতে চাহিতেছে। বিধাতার আশীর্বাদে ব্ৰাহ্মণের পাদুকাঘাতলাভ হয়তো ব্যর্থ হইবে না। নিদ্রা অত্যন্ত গভীর হইলে এইরূপ নিষ্ঠুর আঘাতেই তাহা ভাঙাইতে হয়। যুরোপের কর্মিগণ কর্মজলে জড়িত হইয়া তাহা হইতে নিষ্কৃতির কোনো পথ খুঁজিয়া পাইতেছে না, সে নানা দিকে নানা ধর্মের দ্বারা কর্মকে জগতে গৌরবান্বিত করুন— তাহারা প্রবৃত্তির অনুরোধে নহে, উত্তেজনার অনুরোধে নহে, ধর্মের অনুরোধেই অবিচলিত নিষ্ঠার সহিত, ফলকামনায় একান্ত আসক্ত না হইয়া, প্ৰাণ সমর্পণ করিতে প্ৰস্তুত হউন। নতুবা ব্ৰাহ্মণ প্রতিদিন শূদ্ৰ, সমাজ প্রত্যহ ক্ষুদ্র এবং প্রাচীন ভারতবর্ষের কুহেলিকার ন্যায়, বিলীন হইয়া যাইবে এবং কর্মক্লান্ত একটি বৃহৎ কেরানি-সম্প্রদায় এক পাটি বৃহৎ পাদুকা প্ৰাণপণে আকর্ষণ করিয়া ক্ষুদ্র কৃষ্ণপিপীলিকাশ্রেণীর মতো মৃত্তিকাতলাবতী বিবরের অভিমুখে ধাবিত হওয়াকেই জীবনযাত্ৰানির্বাহের একমাত্র পদ্ধতি বলিয়া গণ্য করিবে । আষাঢ় ১৩০৯ চীনেম্যানের চিঠি “জন চীনেম্যানের চিঠি’ বলিয়া একখানি চটি বই ইংরাজিতে বাহির হইয়াছে। চিঠিগুলি ইংরাজকে সম্বোধন করিয়া লেখা হইয়াছে। লেখক নিজের বিষয়ে বলেন— "দীর্ঘকাল ইংলন্ডে বাস করার দরুন তোমাদের (ইংরাজদের ) আচার অনুষ্ঠান। —সম্বন্ধে কথা কহিবার কিছু অধিকার আমার জন্মিয়াছে। অপর পক্ষে, স্বদেশ হইতে দূরে আছি বলিয়া আমাদের সম্বন্ধেও আলোচনা করিবার ক্ষমতা খোওয়াইয়া বসি নাই। চীনেম্যান সর্বত্রই সর্বদাই চীনেম্যানই থাকে; এবং কোনো কোনো বিশেষ দিক হইতে বিলাতি সভ্যতাকে আমি যতই পছন্দ করি।-না কেন, এখনো ইহার মধ্যে এমন কিছু দেখি নাই যাহাতে পূর্বদেশের মানুষ হইয়া জন্মিয়াছি বলিয়া আমার মনে কোনোপ্রকার ক্ষোভ হইতে পারে।”