পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ܓ ܓ ܪ ভূমিখণ্ড, ইহার দেবীপীঠ ও পূজাপদ্ধতি, আত্মীয়দের মধ্যে বিবাদমীমাংসার বিচারব্যবস্থা, এ-সমস্তই পরিবারের মধ্যে সরকারি। চীনদেশে নিজের দোষে ছাড়া কোনো লোক একলা পড়ে না। চীনে কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে তোমাদের মতো ধনী হইয়া উঠা সহজ নহে, তেমনি তাহার পক্ষে অনাহারে মরাও শক্ত ; যেমন রোজগারের জন্য অত্যন্ত ঠেলা ঠেলি করিবার উত্তেজনা তাহার নাই, তেমনি প্ৰবঞ্চনা এবং পীড়ন করিবার প্রলোভনও তাহার অল্প। অত্যাকাঙক্ষার তাড়না এবং অভাবের আশঙ্কা হইতে মুক্ত হইয়া,জীবনযাত্রার উপকরণ -উপার্জনের অবিশ্রাম চেষ্টা ছাড়িয়া, জীবনযাত্রার জন্যই সে অবসর লাভ করে। প্রকৃতির দান-সকল উপভোগ করিতে, শিষ্টতার চর্চা করিতে এবং মানুষের সঙ্গে সহৃদয় নিঃস্বার্থ সম্বন্ধ পাতাইয়া বসিতে তাহার ভিতরের স্বভাব এবং বাহিরের সুযোগ দুই’ই অনুকুল । ইহার ফল হইয়াছে এই যে, ধর্মের দিকেই বলো, আর মাধুর্যের দিকেই বলো, তোমাদের যুরোপের অধিকাংশ অধিবাসীর চেয়ে আমাদের লোকেরা শ্রেষ্ঠতা লাভ করিয়াছে। তোমাদের কার্যকরী এবং বৈজ্ঞানিক সফলতার মহত্ত্ব আমরা স্বীকার করি ; কিন্তু স্বীকার করিয়াও, তোমাদের যে সভ্যতা হইতে বড়ো বড়ো শহরে এমন রূঢ় আচার, এমন অবনত ধর্মনীতি এবং বাহ্যিশোভনতার এমন বিকার উৎপন্ন হইয়াছে, সে সভ্যতাকে আমরা সমস্ত মন দিয়া প্ৰশংসা করা অসম্ভব দেখি । তোমরা যাহাকে উন্নতিশীল জাত বলে আমরা তাহা নাই। এ কথা মানিতে রাজি আছি, আমাদের ধর্মৈিনতিক লাভকেই আমরা শিরোধাৰ্য্য করি, এবং তোমাদের সেই সম্পদ হইতে যদি বঞ্চিত হইতে হয় সেও স্বীকার, তবু আমাদের যে-সকল আচার-অনুষ্ঠান আমাদের ধর্মলাভকে সুনিশ্চিত এই গেল প্ৰথম পত্র। দ্বিতীয় পত্রে লেখক অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছেন। তিনি বলেন “আমাদের যাহা দরকার তাহাই আমরা উৎপন্ন করি, আমরা যাহা উৎপন্ন করি তাহা আমরাই খাই। অন্য জাতের উৎপন্ন দ্রব্য আমরা চাহি নাই, আমাদের দরকারও হয় নাই। আমাদের মতে সমাজের স্থিতি রক্ষা করিতে হইলে, তাহার আর্থিক স্বাধীনতা থাকা চাই। বৃহৎ বিদেশী বাণিজ্য সামাজিক ভ্ৰষ্টতার একটা নিশ্চিত কারণ। “তোমরা যাহা খাইতে চাও তাহা তোমরা উৎপন্ন করিতে পার না, তোমাদিগকে যাহা উৎপন্ন করিতে হয় তাহা তোমরা ফুরাইতে পার না। প্ৰাণের দায়ে এমনতরো কেনাবেচার গঞ্জ তোমাদের দরকার যেখানে তোমাদের কারখানার মাল চালাইতে পার এবং খাদ্য এবং কৃষিজাত দ্রব্য কিনিতে পার। অতএব যেমন করিয়া হউক, চীনকে তোমাদের দরকার। “তোমরা চাও আমরাও ব্যাবসাদার হই এবং আমাদের রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক যে স্বাধীনতা আছে তাহা বিসর্জন দিই। ; কেবল যে আমাদের সমস্ত কাজ কারবার উলটাপালট করিয়া দিই তাহা নহে, আমাদের আচারব্যবহার, ধর্ম, আমাদের সাবেক রীতিনীতি, সমস্তই বিপর্যন্ত করিয়া ফেলি। এমত অবস্থায় তোমাদের দশটা কী হইয়াছে তাহা যদি বেশ করিয়া আলোচনা করিয়া দেখি, তবে আশা করি মাপ করিবে । “যাহা দেখা যায় সেটা তো বড়ো উৎসাহজনক নহে। প্ৰতিযোগিতা-নামক একটা দৈত্যকে তোমরা ছাড়িয়া দিয়াছ, এখন আর সেটাকে কিছুতেই কায়দা করিতে পারিতেছ না। তোমাদের গত একশো বৎসরের বিধিবিধান কেবল এই আর্থিক বিশৃঙ্খলাকে সংযত করিবার জন্য অবিশ্রাম নিস্ফল চেষ্টা মাত্ৰ। তোমাদের গরিবেরা, মাতালেরা, অক্ষ মেরা, তোমাদের পীড়া ও জরা -গ্ৰস্তগণ একটা বিভীষিকার মতো তোমাদের ঘাড়ে চাপিয়া আছে। মানুষের সহিত সমস্ত ব্যক্তিগত বন্ধন তোমরা ছেদন করিয়া বসিয়া আছ, এখন স্টেট অর্থাৎ সরকারের অব্যক্তিক উদ্যমের দ্বারা তোমরা ব্যক্তির সমস্ত কােজ সারিয়া লইবার বৃথা চেষ্টা করিতেছ। তোমাদের সভ্যতার প্রধান লক্ষণ দায়িত্ববিহীনতা।