পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভারতবর্ষ A. Գ Հ@ মধ্যে তোমরা তোমাদের সমস্ত সমাজকে উলটাইয়া দিয়াছ। সম্পত্তি, বিবাহ, ধর্ম, চরিত্র, শ্রেণীবিভাগ, পদবিভাগ, অর্থাৎ মানবসম্বন্ধগুলির মধ্যে যাহা-কিছু সব চেয়ে উদার ও গভীর, তাহাদিগকে একেবারে শিকড়ে ধরিয়া উপড়াইয়া কালের স্রোতে আবর্জনার মতো ভাসাইয়া দেওয়া হইয়াছে। এইজন্যই তোমাদের গবমেন্টকে এত বেশি উদ্যম প্ৰকাশ করিতে হয়- কারণ, গবমেন্ট নহিলে কে তোমাদের সমাজকে ধারণ করিয়া রাখিবে ? তোমাদের পক্ষে গবমেন্ট যত একান্ত আবশ্যক, সৌভাগ্যক্রমে আমাদের পূর্বদেশের পক্ষে তত নয়। আমার কাছে এটা একটা অমঙ্গল বলিয়াই বোধ হয় ; কিন্তু দেখিতেছি, ইহা নাহিলেও তোমাদের চলিবার উপায় নাই। তবু এত বড়ো কাজটা যাহাকে দিয়া আদায় করিতে চাও, সেই যন্ত্রটার অসামান্য অপটুতা দেখিয়া আমি আরো আশ্চর্য হই। যোগ্য লোক –নির্বাচনের সুনিশ্চিত উপায় আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করা দুরূহ। সে কথা স্বীকার করি, কিন্তু তবু এটা বড়োই অদ্ভুত যে যাহাদের উপরে এমন একটা মহৎ ভার দেওয়া হয় তাহাদের ধর্মনৈতিক ও বুদ্ধিগত সামর্থ্যের কোনোপ্রকার পরীক্ষার চেষ্টা হয় না। “ইলেকশন ব্যাপারটার অর্থ কী ? তোমরা মুখে বল, তাহার অর্থ জনসাধারণের দ্বারা প্ৰতিনিধিনির্বাচন- কিন্তু তোমরা মনে মনে কি নিশ্চয় জান না। তাহার অর্থ তাহা নহে? বস্তুত এক-একটি দলীয় স্বার্থেরই প্ৰতিনিধি নির্বাচিত হয়। জমিদার, মদের কারখানার কর্তা, রেল—কোম্পানির অধ্যক্ষ--- ইহারাই কি তোমাদিগকে শাসন করিতেছে না ? আমি জানি একদল আছে তাহারা “মাস' অর্থাৎ জনসাধারণের প্রচণ্ড পশুশক্তিকেও এই কর্তৃপক্ষদের দলভুক্ত করিয়া সামঞ্জস্য সাধন করিতে চাহে। কিন্তু তোমাদের দেশে জনসাধারণাও যে একটা স্বতন্ত্র বিশেষ দল, তাহদেরও একটা দলগত সংকীর্ণ স্বাৰ্থ আছে। তোমাদের এই যন্ত্রটার উদ্দেশ্য দেখিতেছি, একটা গর্তের মধ্যে কতকগুলা প্ৰাইভেট স্বার্থের আত্মম্ভরি শক্তিকে ছাড়িয়া দেওয়া— তাহারা শুদ্ধমাত্র পরস্পর লড়াইয়ের জোরেই সাধারণের কল্যাণে উপনীত হইবে। ধর্ম এবং সাদবিবেচনার কর্তৃত্বের উপর চীনেম্যানের এমন একটা মাজাগতি শ্রদ্ধা আছে যে, তোমাদের এই প্ৰণালীকে আমার ভালোই বোধ হয় না। তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যত্র আমি এমন-সকল লোক দেখিয়াছি র্যাহারা তোমাদের ব্যবস্থাযোগ্য সমস্ত বিষয়গুলিকে সুগভীরভাবে আলোচনা করিয়াছেন, যাহাদের বুদ্ধি পরিষ্কৃত, বিচার পক্ষপাতশূন্য, উৎসাহ নিঃস্বার্থ এবং নির্মল, কিন্তু তাহারা তাহাদের প্রাজ্ঞতাকে কোনো কাজে লাগাইবার আশাও করিতে পারেন না— কারণ, তাহাদের প্রকৃতি, তাহাদের শিক্ষা, তাহাদের অভ্যাস, জানপাদিক ইলেকশনের উপদ্রব সহ্য করিবার পক্ষে তাহাদিগকে অপটু করিয়াছে। পার্লামেন্টের সভ্য হওয়াও একটা ব্যাবসা-বিশেষ— এবং ধর্মৈিনতিক ও মানসিক যে-সকল গুণ সাধারণের মঙ্গলসাধনের জন্য আবশ্যক এই ব্যবসায়ে প্রবেশ করিবার গুণ তাহা হইতে স্বতন্ত্র বলিয়াই বোধ হয়।” আমি সংক্ষেপে চীনেম্যানের পত্রের প্রধান অংশগুলি উপরে বিবৃত করিলাম। এই পত্রগুলি পড়িলে প্ৰাচ্যসমাজের সাধারণ ভিত্তি সম্বন্ধে আমাদের পরস্পরের যে ঐক্য, তাহা বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু ইহাও দেখিতে পাই, এই—যে শান্তি এবং শৃঙ্খলা, সন্তোষ এবং সংযমের উপরে সমস্ত সমাজকে গডিয়া তোলা, তাহার চরম সার্থকতার কথা এই চিঠিগুলির মধ্যে পাওয়া যায় না। চীনদেশ সুখী, সন্তুষ্ট, কর্মনিষ্ঠ হইয়াছে, কিন্তু সেই সার্থকতা পায় নাই। অসুখে অসন্তোষে মানুষকে ব্যর্থ করিতে নাই ; নিজের এলাকার মধ্যে নিজের সমস্ত চেষ্টাকে বদ্ধ করিয়া সুখী হইয়াছি। কিন্তু এ কথা যথেষ্ট নহে। এই সংকীর্ণতাটুকুর মধ্যে সকল উৎকর্ষ লাভ করাকেই চরম মনে করিলে হতাশ হইতে হয়। জলধারা যদি সমুদ্রকে চায়, তবে নিজেকে দুই তাঁটের মধ্যে সংহত সংযত করিয়া তাহাকে চলিতে হয়, কিন্তু তাই বলিয়া নিজেকে এক জায়গায় আনিয়া বদ্ধ করিলে চলে না। মুক্তির জন্যই তাহাকে সংযত হইতে হয়, কিন্তু নিজেকে বন্দী করিলে তাহার চরম উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়- তাহা হইলে নদীকে ঝিল হইতে হয় এবং স্রোতের অন্তহীন ধারাকে সমুদ্রের অন্তহীন তৃপ্তির মধ্যে লইয়া যাওয়া হয় না।