পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভারতবর্ষ। १२१ হইব- জগতের মধ্যে আমাদের প্রতিষ্ঠা হইবে, প্ৰাচীন ভারতের তপোবনে ঋষিরা যে যজ্ঞ করিয়াছিলেন তাহা সফল হইবে এবং পিতামহগণ আমাদের মধ্যে কৃতাৰ্থ হইয়া আমাদিগকে আশীৰ্বাদ করিবেন। আষাঢ় ১৩০৯ প্ৰাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা আলোচনার যোগ্য। প্রথমে তাহার মত নিম্নে উদধূত করি। তিনি বলেন, আধুনিক যুরোপীয় সভ্যতার পূর্ববর্তী কালে, কি এশিয়ায় কি অন্যত্র, এমন-কি, প্রাচীন গ্ৰীস-রোমেও, সভ্যতার মধ্যে একটি একমুখী ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। প্রত্যেক সভ্যতা যেন একটি মূল হইতে উঠিয়াছে এবং একটি ভাবকে আশ্রয় করিয়া অধিষ্ঠিত রহিয়াছে; সমাজের মধ্যে কর্তৃত্ব দেখা যায়। যেমন, ইজিপ্টে এক পুরোহিতশাসনতন্ত্রে সমস্ত সমাজকে অধিকার করিয়া বসিয়াছিল; তাহার আচারব্যবহারে, তাহার কীর্তিস্তম্ভগুলিতে, ইহারই একমাত্র প্রভাব। ভারতবর্ষেও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রে সমস্ত সমাজকে একভাবে গঠিত করিয়া তুলিয়াছিল। সময়ে সময়ে ইহাদের মধ্যে ভিন্ন শক্তির বিরোধ উপস্থিত হয় নাই তাহা বলা যায় না, কিন্তু তাহারা সেই কর্তৃভাবের দ্বারা পরাস্ত হইয়াছে। এইরূপ এক ভাবের কর্তৃত্বে ভিন্ন দেশ ভিন্ন রূপ ফললাভ করিয়াছে। সমগ্র সমাজের মধ্যে এই ভাবের ঐক্যবশত গ্ৰীস অতি আশ্চর্য দ্রুতবেগে এক অপূর্ব উন্নতি লাভ করিয়াছিল। আর-কোনো জাতিই এত অল্পকালের মধ্যে এমন উজ্জ্বলতা লাভ করিতে পারে নাই। কিন্তু গ্ৰীস তাহার উন্নতির চরমে উঠিতে না উঠিতেই যেন জীর্ণ হইয়া পড়িল। তাহার অবনতিও বড়ো আকস্মিক ! যে মূলভাবে গ্ৰীক সভ্যতায় প্রাণসঞ্চার করিয়াছিল তাহা যেন রিক্ত নিঃশেষিত হইয়া গেল ; আর-কোনো নূতন শক্তি আসিয়া তাহাকে বলদান বা তাহার স্থান অধিকার করিল না। অপর পক্ষে, ভারতবর্ষে ও ইজিপ্টেও সভ্যতার মূলভাব এক বটে, কিন্তু সমাজকে তাহা আচল করিয়া রাখিল ; তাহার সরলতায় সমস্ত যেন একঘেয়ে হইয়া গেল। দেশ ধবংস হইল না, সমাজ টিকিয়া রহিল, কিন্তু কিছুই অগ্রসর হইল না, সমস্তই এক জায়গায় আসিয়া বদ্ধ হইয়া গেল। প্রাচীন সভ্যতামাত্রেই একটা-না-একটা কিছুর একাধিপত্য ছিল। সে আর কাহাকেও কাছে আসিতে দিত না, সে আপনার চারি দিকে আটঘটি বাধিয়া রাখিত। এই ঐক্য, এই সরলতার ভাব সাহিত্যে এবং লোকসকলের বুদ্ধিচেষ্টার মধ্যেও আপন শাসন বিস্তার করিত। এই কারণেই প্রাচীন হিন্দুর ধর্ম ও চারিত্র গ্রন্থে ইতিহাসে কাব্যে সর্বত্রই একই চেহারা দেখিতে পাওয়া যায়। তাঁহাদেৱ জ্ঞানে এবং কল্পনায়, তাহাদের জীবনযাত্রায় এবং অনুষ্ঠানে এই একই ছাদ। এমন-কি, গ্ৰীসেও জ্ঞানবুদ্ধির বিপুল ব্যাপ্তি-সত্ত্বেও, তাহার সাহিত্যে ও শিল্পে এক আশ্চর্য একপ্রবণতা দেখা যায়। য়ুরোপের আধুনিক সভ্যতা ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। এই সভ্যতার উপর দিয়া একবার চােখ বুলাইয়া যাও, দেখিবে তাহা কী বিচিত্র জটিল এবং বিক্ষুব্ধ। ইহার অভ্যন্তরে সমাজতন্ত্রের সকল-রকম মূলতত্ত্বই বিরাজমান; লৌকিক এবং আধ্যাত্মিক শক্তি, পুরোহিততন্ত্র রাজতন্ত্র প্রধানতন্ত্র প্রজাতন্ত্র সমাজপদ্ধতির সকল পর্যায় সকল অবস্থাই বিজড়িত হইয়া দৃশ্যমান; স্বাধীনতা ঐশ্বর্য এবং ক্ষমতার সর্বপ্রকার ক্রমান্বয় ইহার মধ্যে স্থান গ্রহণ করিয়াছে। এই বিচিত্ৰ শক্তি স্থির নাই, ইহারা আপনা-আপনির মধ্যে কেবল লড়িতেছে। অথচ ইহাদের কেহই আর-সকলকেই অভিভূত করিয়া