পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Տ)8 রবীন্দ্র-রচনাবলী পারিলেই স্বার্থসাধন হয়, কিন্তু সম্পূর্ণ বিবেকের সঙ্গে কাজ না করিলে কেবল কাজের দ্বারা মঙ্গলসাধন হইতে পারে না । তিথিনক্ষত্রের বিভীষিকা এবং জন্মজন্মান্তরের সদগতির লোভ —দ্বারা মঙ্গলকাজ করাইবার চেষ্টা করিলে কেবল কাজই করানো হয়, মঙ্গল করানো হয় না। কারণ, মঙ্গল স্বার্থের ন্যায় অন্য লক্ষ্যের অপেক্ষা করে না, মঙ্গলেই মঙ্গলের পূর্ণতা। কিন্তু বৃহৎ জনসমাজকে এক আদর্শে বাধিবার সময় মানুষের ধৈর্য থাকে না। তখন ফললাভের প্ৰতি তাহার আগ্ৰহ ক্ৰমে যতই বাড়িতে থাকে, ততই উপায় সম্বন্ধে তাহার। আর বিচার থাকে না। রাষ্ট্রহিতৈষ যে-সকল দেশের উচ্চতম আদর্শ সেখানেও এই অন্ধতা দেখিতে পাওয়া যায়। রাষ্ট্ৰহিতৈষার চেষ্টাবেগ যতই বাড়িতে থাকে ততই সত্য-মিথ্যা ন্যায়-অন্যায়ের বুদ্ধি তিরোহিত হইতে থাকে। ইতিহাসকে অলীক করিয়া, প্রতিজ্ঞাকে লঙ্ঘন করিয়া, ভদ্রনীতিকে উপেক্ষা করিয়া, বলিয়া বোধ হইতে থাকে— অবশেষে, ধর্ম, যিনি সকলকে ধারণ করিয়া রক্ষা করেন, তাহাকে সবলে আঘাত করিয়া নিজের আশ্রয়শাখাটিকেই ছেদন করা হয়। ধর্ম কলের মধ্যেও বিনষ্ট হন, বলের দ্বারাও বিক্ষিপ্ত হইয়া থাকেন। আমরা আমাদের মঙ্গলকে কলের মধ্যে ধরিয়া রাখিতে গিয়া মারিয়া ফেলিয়াছি, য়ুরোপ স্বার্থোল্পতিকে বলপূর্বক চাপিয়া রাখিতে গিয়া প্রত্যহই বিনাশ করিতেছে। অতএব আমাদের প্রাচীন সমাজ আজ নিজের মঙ্গল হারাইয়াছে, দুৰ্গতির বিস্তীর্ণ জালের মধ্যে অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে জড়ীিভূত হইয়া আছে, ইহা প্রত্যক্ষ দেখিতেছি বটে ; তবু বলিতে হইবে, মঙ্গলকেই লাভ করিবার জন্য ভারতবর্ষে সর্বাঙ্গীণ চেষ্টা ছিল। স্বার্থসাধনের প্রয়াসই যদি স্বভাবের সহজ নিয়ম হয়, তবে সে নিয়মকে ভারতবর্ষ উপেক্ষা করিয়াছিল। সেই নিয়মকে উপেক্ষা করিয়াই যে তাহার দুৰ্গতি ঘটিয়াছে তাহা নহে, কারণ, সে নিয়মের বশবর্তী হইয়াও গুরুতর দুৰ্গতি ঘটে—কিন্তু সমাজকে সকল দিক হইতে মঙ্গলজালে জড়িত করিবার প্রবল চেষ্টায় অন্ধ হইয়া সে নিজের চেষ্টাকে ব্যর্থ করিয়াছে। ধৈর্যের সহিত যদি জ্ঞানের উপর এই মঙ্গলকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করি, তবে আমাদের সামাজিক আদর্শ সভ্যজগতের সমুদয় আদর্শের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইবে। অর্থাৎ, আমাদের পিতামহদের শুভ ইচ্ছাকে যদি কলের দ্বারা সফল করিবার চেষ্টা না করিয়া জ্ঞানের দ্বারা সফল করিবার চেষ্টা করি, তবে ধর্ম আমাদের সহায় হইবেন। কিন্তু কল জিনিসটাকে একেবারে বরখাস্ত করা যায় না। এক-এক দেবতার এক-এক বাহন আছে- সম্প্রদায়-দেবতার বাহন কল। বহুতর লোককে এক আদর্শে গঠিত করিতে গেলে বোধ করি বারো-আনা লোককে অন্ধ অভ্যাসের বশবর্তী করিতে হয়। জগতে যত ধৰ্মসম্প্রদায় আছে তাহাদের মধ্যে সজ্ঞান নিষ্ঠাসম্পন্ন লোক বেশি পাওয়া যায় না। খ্রীস্টানজাতির মধ্যে আন্তরিক খ্রীস্টান কত অল্প তাহা দুৰ্ভাগ্যক্রমে আমরা জানিতে পাইয়াছি- এবং হিন্দুদের মধ্যে অন্ধ-সংস্কারবিমুক্ত যথার্থ জ্ঞানী হিন্দু যে কত বিরল তাহা আমরা চিরাভ্যাসের জড়তাবশত ভালো করিয়া জানিতেও পাই না। সকল লোকের প্রকৃতি যখন এক হয় না। তখন এক আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করিতে গেলে অনেক বাজে মাল-মসলা আসিয়া পড়ে। যে-সকল বাছা-বাছা লোক এই আদর্শের অনুসারী তাহারা সাম্প্রদায়িক কলের ভাবটাকে প্ৰাণের দ্বারা ঢালিয়া লন। কিন্তু কলটাই যদি বিপুল হইয়া উঠিয়া প্ৰাণকে পিষিয়া ফেলে, প্ৰাণকে খেলিবার সুবিধা না দেয়, তবেই বিপদ। সকল দেশেই মাঝে মাঝে মহাপুরুষরা উঠিয়া সামাজিক কলের বিরুদ্ধে সকলকে সচেতন করিতে চেষ্টা করেন- সকলকে সতর্ক করিয়া বলেন, কলের অন্ধ গতিকেই সকলে প্ৰাণের গতি বলিয়া যেন ভ্ৰম না করে। অল্পদিন হইল, ইংরেজ-সমাজে কার্লাইল এইরূপ চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। অতএব বাহনটিই যখন সমাজদেবতার কঁধের উপর চিড়িয়া বসিবার চেষ্টা করে, যন্ত্র যখন যন্ত্রীকেই নিজের যন্ত্রস্বরূপ করিবার উপক্রম করে, তখন সমাজে ও সমাজের কলে মাঝে-মাঝে বুটাপুটি বাধিয়া যায়। মানুষ যদি সেই যুদ্ধে কলের উপর তুষ্ট হয় তাে ভালাে, আর কল যদি মানুষকে পরাভূত করিয়া চাকার নীচে চাপিয়া রাখে। তবেই