পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ 8 Օ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী পরিমাণে যন্ত্রমাত্র, তাহাতে নিজের ধর্মপ্রবৃত্তির সর্বতোভাবে সম্পূর্ণ চৰ্চা হয় না। তাহা ধৰ্মসাধন অপেক্ষা প্রয়োজন-সাধনের পক্ষে অধিক উপযোগী । কিন্তু কালের এবং ভাবের পরিবর্তন হইতেছে। চারি দিকেই দল বাধিয়া উঠিতেছে, কিছুই নিভৃত এবং কেহই গোপন থাকিতেছে না। নিজের কীর্তির মধ্যেই নিজেকে কৃতাৰ্থ করা, নিজের মঙ্গলচেষ্টার মধ্যেই নিজেকে পুরস্কৃত করা, এখন আর টেকে না। শুভকর্ম এখন আর সহজ এবং আত্মবিস্মৃত নহে, এখন তাহা সর্বদাই উত্তেজনার অপেক্ষা রাখে। যে-সকল ভালো কাজ ধ্বনিত হইয়া উঠে না। আমাদের কাছে তাহার মূল্য প্রতিদিন কমিয়া আসিতেছে, এইজন্য ক্রমশ আমাদের গৃহ পরিত্যক্ত, আমাদের জনপদ নিঃসহায়, আমাদের জন্মগ্রাম রোগজীর্ণ, আমাদের পল্লীর সরোবর-সকল পঙ্কদূষিত, আমাদের সমস্ত চেষ্টাই কেবল সভাসমিতি এবং সংবাদপত্র-হাটের মধ্যে। ভ্ৰাতৃভাব এখন ভ্রাতাকে ছাড়িয়া বাহিরে ফিরিতেছে, দয়া এখন দীনকে ছাড়িয়া সংবাদদাতার স্তম্ভের উপর চডিয়া দাড়াইতেছে, এবং লোকহিতৈষিতা এখন লোককে ছাড়িয়া রাজদ্বারে খেতাব খুজিয়া বেড়াইতেছে। ম্যাজিষ্ট্রেটের তাড়া না খাইলে এখন আমাদের গ্রামে স্কুল হয় না, রোগী ঔষধ পায় না, দেশের জলকষ্ট দূর হয় না। এখন ধ্বনি এবং ধন্যবাদ এবং করতালির নেশা যখন চড়িয়া উঠিয়াছে তখন সেই প্রলোভনের ব্যবস্থা রাখিতে হয়। ঠিক যেন বাছুরটাকে কসাইখানায় বিক্রয় করিয়া ফুকা-দেওয়া-দুধের ব্যবসায় চালাইতে হইতেছে। অতএব আমরা যে দল বাধিয়া শোক, দল বাধিয়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য পরস্পরকে প্ৰাণপণে উৎসাহিত করিতেছি, এখন তাহার সময় আসিয়াছে। কিন্তু পরিবর্তনের সন্ধিকালে ঠিক নিয়মমত কিছুই হয় না। সকালে হয়তো শীতের আভাস, বিকালে হয়তো বসন্তের বাতাস দিতে থাকে। দিশি হালকা কাপড় গায়ে দিলে হঠাৎ সর্দি লাগে, বিলাতি মোটা কাপড় গায়ে দিলে ঘৰ্মাক্তকলেবর হইতে হয়। সেইজন্য আজকাল দিশি ও বিলাতি কোনো নিয়মই পুরাপুরি খাটে না । যখন বিলাতি প্রথায় কাজ করিতে যাই, দেশী সংস্কার অলক্ষ্যে হৃদয়ের অন্তঃপুরে থাকিয়া বাধা দিতে থাকে, আমরা লজ্জায় ধিককারে অস্থির হইয়া উঠি- দেশী ভাবে যখন কাজ ফাদিয়া বসি তখন বিলাতের রাজ-অতিথি আসিয়া নিজের বসিবার উপযুক্ত আসন না পাইয়া নাসা কুঞ্চিত করিয়া সমস্ত মাটি করিয়া দেয়। সভা-সমিতি নিয়মমত ডাকি, অথচ তাহা সফল হয় না— চাদার খাতা খুলি, অথচ তাহাতে যেটুকু অঙ্কপাত হয় তাহাতে কেবল আমাদের কলঙ্ক ফুটিয়া উঠে। আমাদের সমাজে যেরূপ বিধান ছিল তাহাতে আমাদের প্রত্যেক গৃহস্থকে প্রতিদিন চাঁদা দিতে হইত। তাহার তহবিল আত্মীয়স্বজন অতিথি-অভ্যাগত দীনদুঃখী সকলের জন্যই ছিল। এখনো আমাদের দেশে যে দরিদ্র সে নিজের ছোটাে ভাইকে স্কুলে পড়াইতেছে, ভগিনীর বিবাহ দিতেছে, পৈতৃক নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়া সাধন করিতেছে, বিধবা পিসি-মাসিকে সসন্তান পালন করিতেছে। ইহাই দিশি মতে চাদ, ইহার উপরে আবার বিলাতি মতে চান্দা লোকের সহ্য হয় কী করিয়া ? ইংরাজ নিজের ভোগেরই জন্য যাহার তহবিল তাহাকে বাহ্য উপায়ে স্বার্থত্যাগ করাইলে ভালোই হয়। আমাদের কয়জন লোকের নিজের ভোগের জন্য কতটুকু উদ্যবৃত্ত থাকে ? ইহার উপরে বারো মাসে তেরো শত বিনয় রক্ষা করা কঠিন হয়। আমরা ক্রমাগতই লজ্জিত হইয়া বলিতেছি, এত বড়ো অনুষ্ঠানপত্র বাহির করিলাম, টাকা আসিতেছে না কেন- এত বড়ো ঢাক পিটাইতেছি, টাকা আসিয়া পড়িতেছে না। কেন- এত বড়ো কাজ আরম্ভ করিলাম, অর্থাভাবে বন্ধ হইয়া যাইতেছে কেন ? বিলাত হইলে এমন হইত, তেমন হইত, হু হু করিয়া মুষলধারে টাকা বর্ষিত হইয়া যাইত— কবে আমরা বিলাতের মতো হইব ? বিলাতের আদর্শ আসিয়া পৌঁছিয়াছে, বিলাতের অবস্থা এখনো বহু দূরে। বিলাতি মতের লজ্জা পাইয়াছি, কিন্তু সে লজ্জা নিবারণের বহুমূল্য বিলাতি বস্ত্র এখনো পাই নাই। সকল দিকেই টানাটানি