পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ما ) CR পলিটিকস এবং নেশন কথাটা যেমন যুরোপের কথা, ধর্ম কথাটাও তেমনি ভারতবর্ষের কথা। পলিটিকস এবং নেশন কথাটার অনুবাদ যেমন আমাদের ভাষায় সম্ভবে না তেমনি ধর্ম শব্দের প্রতিশব্দ যুরোপীয় ভাষায় খুঁজিয়া পাওয়া অসাধ্য। এইজন্য ধর্মকে ইংরেজি রিলিজন রূপে কল্পনা করিয়া আমরা অনেক সময়ে ভুল করিয়া বসি। এইজন্য, ধর্মচেষ্টার ঐক্যই যে ভারতবর্ষের ঐক্য এ কথা বলিলে তাহা অস্পষ্ট শুনাইবে । মানুষ মুখ্যভাবে কোন ফলের প্রতি লক্ষ করিয়া কর্ম করে তাহাই তাহার প্রকৃতির পরিচয় দেয়। লাভ করিব। এ লক্ষ্য করিয়াও টাকা করা যায়, কল্যাণ করিব। এ লক্ষ্য করিয়াও টাকা করা যায়। যে ব্যক্তি কল্যাণকে মানে টাকা করিবার পথে তাহার অনেক অপ্রাসঙ্গিক বাধা আছে, সেগুলিকে সাবধানে কাটাইয়া। তবে তাহাকে অগ্রসর হইতে হয়— যে ব্যক্তি লাভকেই মানে তাহার পক্ষে ঐ-সকল বাধার অস্তিত্ব নাই। এখন কথা এই, কল্যাণকে কেন মানিব ? অন্তত ভারতবর্ষ লাভের চেয়ে কল্যাণকে, প্ৰেয়ের যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ একা তাহার ভালোমন্দ কর্ম কিছুই নাই। আত্ম-অনত্বের যোগে ভালোমন্দ সকল কমের উদ্ভব । অতএব গোড়ায় এই আত্ম-অনত্বের সত্য-সম্বন্ধ-নির্ণয় আবশ্যক। এই সম্বন্ধনির্ণয় এবং জীবনের কাজে এই সম্বন্ধকে স্বীকার করিয়া চলা, ইহাই চিরদিন ভারতবর্ষের সর্বপ্ৰধান চেষ্টার বিষয় छिळत । ভারতবর্ষে আশ্চর্যের বিষয় এই দেখা যায় যে, এখানে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় এই সম্বন্ধকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে নিৰ্ণয় করিয়াছে, কিন্তু ব্যবহারে এক জায়গায় আসিয়া মিলিয়াছে। ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র দিক হইতে ভারতবর্ষ একই কথা বলিয়াছে। এক সম্প্রদায় বলিয়াছেন, আত্ম-অনত্বের মধ্যে কোনো সত্য প্ৰভেদ নাই। যে প্ৰভেদ প্রতীয়মান হইতেছে তাহার মূলে অবিদ্যা। কিন্তু যদি এক ছাড়া দুই না থাকে। তবে তো ভালোমন্দের কোনো স্থান থাকে না । কিন্তু এত সহজে নিষ্কৃতি নাই। যে অজ্ঞানে এককে দুই করিয়া তুলিয়াছে তাহাকে বিনাশ করিতে হইবে, নতুবা মায়ার চক্ৰে পড়িয়া দুঃখের অন্ত থাকিবে না। এই লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া কর্মের ভালোমন্দ স্থির করিতে হইবে । আর-এক সম্প্রদায় বলেন, এই– যে সংসার আবর্তিত হইতেছে আমরা বাসনার দ্বারা ইহার সহিত আবদ্ধ হইয়া ঘুরিতেছি ও দুঃখ পাইতেছি, এক কর্মের দ্বারা আর-এক কর্ম এবং এইরূপে অন্তহীন কর্মশঙ্খল রচনা করিয়া চলিয়াছি— এই কর্মপাশ ছেদন করিয়া মুক্ত হওয়াই মানুষের একমাত্র শ্রেয়। কিন্তু তবে তো সকল কর্ম বন্ধ করিতে হয়। তাহা নহে, এত সহজে নিষ্কৃতি নাই। কর্মকে এমন করিয়া নিয়মিত করিতে হয় যাহাতে কর্মের দুশোচ্ছদ্য বন্ধন ক্রমশ শিথিল হইয়া আসে। এই দিকে লক্ষ রাখিয়া কোন কর্ম শুভ, কোন কর্ম অশুভ, তাহা স্থির করিতে হইবে। অন্য সম্প্রদায় বলেন, জগৎসংসার ভগবানের লীলা। এই লীলার মলে তাহার প্রেম, তাহার আনন্দ, অনুভব করিতে পারিলেই আমাদের সার্থকতা। এই সার্থকতার উপায়ও পূর্বোক্ত দুই সম্প্রদায়ের উপায় হইতে বস্তুত ভিন্ন নহে। নিজের বাসনাকে খর্ব করিতে না পারিলে ভগবানের ইচ্ছাকে অনুভব করিতে পারা যায় না। ভগবানের ইচ্ছার মধ্যে নিজের ইচ্ছাকে মুক্তিদােনই মুক্তি। সেই মুক্তির প্রতি লক্ষ করিয়াই কর্মের শুভাশুভ স্থির করিতে হইবে। কর্মের অনন্ত শৃঙ্খল হইতে মুক্তিপ্রার্থী র্তাহারাও বাসনাকে উৎপাটিত করিতে চান, ভগবানের প্রেমে র্যাহারা নিজেকে সম্মিলিত করাই শ্রেয় জ্ঞান করেন তাহারাও বিষয়বাসনাকে তুচ্ছ করিবার কথা বলিয়াছেন।