পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

a とかこ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী প্ৰত্যাশা করি নাই তাহাও লাভ করিলাম। সেইজন্য আমরা আপনাতে আপনি বিস্মিত হইয়াছি। সেইজন্য আজ আমাদের বাঙালির চিত্তসম্মিলনের ক্ষেত্ৰ হইতে র্যাহারা পৃথক হইয়া আছেন তাহাদের ব্যবহার আমাদিগকে এমন কঠোর আঘাত করিতেছে — র্যাহারা ভয় পাইতেছেন, দ্বিধা করিতেছেন, সকল দিক বাচাইবার জন্য নিৰ্ম্মফল চেষ্টা করিতেছেন, তাহদের প্রতি আমাদের অস্তরের অবজ্ঞা এমন দুনিবার বেগে উদবেল হইয়া উঠিতেছে। আমাদের মধ্যে র্যাহারা বিলাসে অভ্যস্ত ছিলেন তাহারা বিলাস-উপকরণের জন্য লজিত হইতেছেন, র্যাহাদিগকে চপলচিত্ত বলিয়া জানিতাম তাহারা কঠিন ব্ৰত গ্ৰহণ করিতে কুষ্ঠিত হইতেছেন না, র্যাহারা বিদেশী আড়ম্বরের অগ্নিশিখায় পতঙ্গের মতো বঁাপ দিয়াছিলেন তাহাদিগকে সেই সাংঘাতিক প্ৰলয়দীপ্তি আর প্রলুব্ধ করিতেছে না। ইহার কারণ কী ? ইহার কারণ, আমরা সত্য বস্তুর আভাস পাইয়াছি, সেই সত্যের আবির্ভ আমরা বৃহৎ হইয়াছি, বলিষ্ঠ হইয়াছি। এখন ঈশ্বরের কাছে একান্তমনে প্রার্থনা করি, এই সত্য যেন ক্রমশ উজ্বলতর হইয়া উঠে, এই সত্যকে যেন আবার একদিন শিথিল মুষ্টি হইতে স্বলিত হইতে না দিই, আদ্যকার সংঘাতজনিত উত্তেজনা যখন একদিন শান্ত হইয়া আসিবে তখন যেন জীবনের প্রতিদিন এই সত্যকে আমরা অপ্ৰমত্তচিত্তে সকল কমে ধারণ ও পোষণ করিতে পারি। মনে রাখিতে হইবে, আজ স্বদেশের স্বদেশীয়তা আমাদের কাছে যে প্ৰত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে ইহা রাজার কোনো প্ৰসাদ বা অপ্ৰসাদে নির্ভর করে না ; কোনো আইন পাস হউক বা না হউক, বিলাতের লোক আমাদের করুণোক্তিতে কৰ্ণপাত করুক বা না করুক, আমার স্বদেশ আমার চিরন্তন স্বদেশ, আমার পিতৃপিতামহের স্বদেশ, আমার সন্তানসন্ততির স্বদেশ, আমার প্রাণদাতা শক্তিদাতা সম্পদদাতা স্বদেশ। কোনো মিথ্যা আশ্বাসে ভুলিব না, কাহারও মুখের কথায় ইহাকে বিকাইতে পারিব না, একবার যে হস্তে ইহার স্পর্শ উপলব্ধি করিয়াছি সে হস্তকে ভিক্ষাপাত্রবহনে আর নিযুক্ত করিব না, সে হস্ত মাতৃসেবার জন্য সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করিলাম। আজ আমরা প্ৰস্তুত হইয়াছি। যে পথ কঠিন, যে পথ কণ্টকসংকুল, সেই পথে যাত্রার জন্য প্ৰস্তুত হইয়াছি। আজ যাত্রারম্ভে এখনো মেঘের গর্জন শোনা যায় নাই বলিয়া সমস্তটাকে যেন খেলা বলিয়া মনে না করি। যদি বিদ্যুৎ চকিত হইতে থাকে, বজ ধ্বনিত হইয়া উঠে, তবে তোমরা ফিরিয়ো না, ফিরিয়ো না- দুর্যোগের রক্তচক্ষুকে ভয় করিয়া তোমাদের পৌরুষকে জগৎসমক্ষে অপমানিত করিয়ো না। বাধার সম্ভাবনা জানিয়াই চলিতে হইবে, দুঃখকে স্বীকার করিয়াই অগ্রসর হইতে হইবে, অতিবিবেচকদের ভীত পরামর্শে নিজেকে দুর্বল করিয়ো না। যখন বিধাতার ঝড় আসে, বন্যা আসে, তখন সংযত বেশে আসে না, কিন্তু প্ৰয়োজন বলিয়াই আসে, তাহা ভালোমন্দ লাভক্ষতি দুইই লইয়া আসে। যখন বৃহৎ উদযোগে সমস্ত দেশের চিত্ত বহুকাল নিরুদ্যমের পর প্রথম প্ৰবৃত্ত হয় তখন সে নিতান্ত শাস্তভাবে বিজ্ঞভাবে বিবেচকভাবে বিনীতভাবে প্ৰবৃত্ত হয় না। শক্তির প্রথম জাগরণে মত্ততা থাকেই-- তাহার বেগ, তাহার দুঃখ, তাহার ক্ষতি আমাদের সকলকেই সহ্য করিতে হইবে- সেই সমুদ্রমন্থনের বিষ ও অমৃত উভয়কেই আমাদের স্বীকার করিয়া লইতে হইবে। হে বন্ধুগণ, আজ আমাদের বিজয়া-সম্মিলনের দিনে হৃদয়কে একবার আমাদের এই বাংলাদেশের সর্বত্র প্রেরণ করো। উত্তরে হিমাচলের পদমূল হইতে দক্ষিণে তরঙ্গমুখর সমুদ্ৰকুল পর্যন্ত, নদীজািলজড়িত পূর্বসীমান্ত হইতে শৈলমালাবন্ধুর পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত চিত্তকে প্রসারিত করো। যে চাষি চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগহে এতক্ষণে ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, শঙ্খমুখরিত দেবালয়ে যে পূজার্থী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে । সম্ভাষণ করো। আজ সায়াহ্নে গঙ্গার শাখা-প্ৰশাখা বাহিয়া ব্ৰহ্মপুত্রের কুল-উপকুল দিয়া একবার বাংলাদেশের পূর্বে পশ্চিমে আপন অন্তরের আলিঙ্গন বিস্তার করিয়া দাও, আজ বাংলাদেশের সমস্ত ছায়াতরুনিবিড় গ্রামগুলির উপরে এতক্ষণে যে শারদ আকাশে একাদশীর চন্দ্ৰমা জ্যোৎসাধারা অজস্র ঢালিয়া দিয়াছে সেই নিস্তব্ধ শুচি রুচির সন্ধ্যাকাশে তোমাদের সম্মিলিত হৃদয়ের ‘বন্দেমাতরম'