পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চারিত্রিপূজা a CS উপযুপরি পদাঘাত করিয়া, তাহার প্রাণসংহার করিলেন।” ১ অবশেষে শোণিতজ্ঞসুত বিক্ষতদেহে চারি ক্রোশ পথ হাঁটিয়া মেদিনীপুরে এক আত্মীয়ের গৃহে শয্যা আশ্রয় করেন— দুই মাস পরে সুস্থ হইয়া বাড়ি ফিরিতে পারেন। আর একটিমাত্র ঘটনা উল্লেখ করিলে তর্কভূষণের চরিত্রচিত্র সম্পূর্ণ হইবে। ১৭৪২ শকের ১২ই আশ্বিন মঙ্গলবারে বিদ্যাসাগরের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অদূরে কোমরগঞ্জে মধ্যাহ্নে হাট করিতে গিয়াছিলেন। রামজয় তর্কভূষণ র্তাহাকে ঘরের একটি শুভসংবাদ দিতে বাহির হইয়াছিলেন। পথের মধ্যে পুত্রের সহিত দেখা হইলে বলিলেন, ‘একটি ঐড়ে বাছুর হয়েছে।” শুনিয়া ঠাকুরদাস ঘরে আসিয়া গোয়ালের অভিমুখে গমন করিতেছিলেন ; তর্কভূষণ হাসিয়া কহিলেন, “ও দিকে নয়, এ দিকে এস”—বলিয়া সূতিকাগৃহে লইয়া নবপ্রসূত শিশু ঈশ্বরচন্দ্রকে নির্দেশ করিয়া দেখাইলেন । গিরিশিখরের ন্যায় রমণীয় বোধ হইতেছে। এই হাস্যময় তেজোময় নিভীক ঋজুস্বভাব পুরুষের মতো আদর্শ বাংলাদেশে অত্যন্ত বিরল না হইলে বাঙালির মধ্যে পৌরুষের অভাব হইত না। আমরা তাহার চরিত্ৰবৰ্ণনা বিস্তারিতরূপে উদধূত করিলাম, তাহার কারণ, এই দরিদ্র ব্ৰাহ্মণ তাহার পৌত্রকে আর কোনো সম্পত্তি দান করিতে পারেন নাই, কেবল যে অক্ষয়সম্পদের উত্তরাধিকারবণ্টন একমাত্র ভগবানের হস্তে, সেই চরিত্ৰমাহাত্ম্য অখণ্ডভাবে তাহার জ্যেষ্ঠ পৌত্রের অংশে রাখিয়া গিয়াছিলেন। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও সাধারণ লোক ছিলেন না। যখন তাহার বয়স ১৪ । ১৫ বৎসর এবং যখন তাহার মাতা দুৰ্গাদেবী চরকায় সূতা কাটিয়া একাকিনী তাহার দুই পুত্র এবং চারি কন্যার ভরণপোষণে প্ৰবৃত্ত ছিলেন, তখন ঠাকুরদাস উপার্জনের চেষ্টায় কলিকাতায় প্রস্থান করিলেন। কলিকাতায় আসিয়া প্ৰথমে তিনি তাহার আত্মীয় জগন্মোহন তর্কলংকারের বাড়িতে উঠিলেন। ইংরাজি শিখিলে সওদাগর সাহেবদের হোসে কাজ জুটিতে পরিবে জানিয়া প্রত্যহ সন্ধ্যাবেলায় এক শিপ সরকারের বাডি ইংরাজি শিখিতে যাইতেন। যখন বাড়ি ফিরিতেন তখন তর্কলংকারের বাড়িতে উপরি লোকের আহারের কাণ্ড শেষ হইয়া যাইত, সুতরাং তাহাকে রাত্রে অনাহারে থাকিতে হইত। অবশেষে তিনি তাহার শিক্ষকের এক আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রয় লইলেন। আশ্রয়দাতার দারিদ্র্যনিবন্ধন এক-একদিন তাহাকে সমস্ত দিন উপবাসী থাকিতে হইত। একদিন ক্ষুধার জ্বালায় তাহার যথাসর্বস্ব একখানি পিতলের থালা ও একটি ছোটো ঘটি কঁসিারির দোকানে বেচিতে গিয়াছিলেন । কাসারিরা তাহার। পাচ সিকা দর স্থির করিয়াছিল, কিন্তু কিনিতে সম্মত হইল না ; বলিল, অজানিত লোকের নিকট হইতে পুরানো বাসন কিনিয়া মাঝে মাঝে বড়ো ফ্যাসাদে পড়িতে হয়। - আর-একদিন ক্ষুধার যন্ত্রণা ভুলিবার অভিপ্ৰায়ে মধ্যাহ্নে ঠাকুরদাস বাসা হইতে বাহির হইয়া পথে পথে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন । ‘বড়বাজার হইতে ঠনঠনিয়া পর্যন্ত গিয়া এত ক্লান্ত ও ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় এত অভিভূত হইলেন, যে আর তাহার চলিবার ক্ষমতা রহিল না। কিঞ্চিৎ পাৱেই, তিনি এক দোকানের সম্মুখে উপস্থিত ও দণ্ডায়মান হইলেন ; দেখিলেন, এক মধ্যবয়স্কা বিধবা নারী ঐ দোকানে বসিয়া মুড়ি-মুড়কি বেচিতেছেন। তাহাকে দাড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া, ঐ স্ত্রীলোক জিজ্ঞাসা করিলেন, বা পাঠাকুর, দাড়াইয়া আছ কেন। ঠাকুরদাস, তৃষ্ণার উল্লেখ করিয়া, পানার্থে জলপ্রার্থনা করিলেন। তিনি, সাদর ও সস্নেহ বাক্যে, ঠাকুরদাসকে বসিতে বলিলেন, এবং ব্ৰাহ্মণের ছেলেকে শুধু জল দেওয়া অবিধেয়, এই বিবেচনা করিয়া, কিছু মুড়কি ও জল দিলেন। ঠাকুরদাস যেরূপ ব্যগ্র হইয়া, মুড়কিগুলি খাইলেন, তাহা ১ স্বরচিত বিদ্যাসাগর চরিত ২ সহােদর শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ব -প্ৰণীত বিদ্যাসাগরজীবনচরিত