পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চারিত্রিপূজা a \O নহে-তাহার নির্মল বুদ্ধি এবং উজ্জ্বল দয়া প্ৰাচীন সংস্কারের মোহাবরণ যে এমন অনায়াসে বর্জন করিতে পারে, ইহা আমার নিকট বড়ো বিস্ময়কর বোধ হয়। লৌকিক প্রথার বন্ধন রমণীর কাছে যেমন দৃঢ় এমন আর কার কাছে ? অথচ, কী আশ্চর্য স্বাভাবিক চিত্তশক্তির দ্বারা তিনি জড়তাময় প্রথাভিত্তি ভেদ করিয়া নিত্যজ্যোতির্ময় অনন্ত বিশ্বধর্মকাশের মধ্যে উত্তীর্ণ হইলেন ! এ কথা তাহার কাছে এত । সহজ বোধ হইল কী করিয়া যে, মনুষ্যের সেবাই যথার্থ দেবতার পূজা। তাহার কারণ, সকল সংহিতা অপেক্ষা প্ৰাচীনতম সংহিতা তাহার হৃদয়ের মধ্যে স্পষ্টাক্ষরে লিখিত ছিল। সিবিলিয়ান হ্যারিসন সাহেব যখন কার্যোপলক্ষে মেদিনীপুর জেলায় গমন করেন, তখন ভগবতীদেবী তাহাকে স্বনামে পত্র পাঠাইয়া বাড়িতে নিমন্ত্ৰণ করিয়া আনিয়াছিলেন ; তৎসম্বন্ধে তাহার তৃতীয় পুত্ৰ শম্ভুচন্দ্ৰ নিম্নলিখিত বৰ্ণনা প্ৰকাশ করিয়াছেন।— ‘জননীদেবী, সাহেবের ভোজনসময়ে উপস্থিত থাকিয়া তাহাকে ভোজন করাইয়াছিলেন। তাহাতে সাহেব আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছিলেন, যে, অতি বৃদ্ধা হিন্দু স্ত্রীলোক, সাহেবের ভোজনের সময়ে চেয়ারে উপবিষ্ট হইয়া কথাবাৰ্ত্ত কহিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন। --সাহেব হিন্দুর মত জননীদেবীকে ভূমিষ্ঠ হইয়া মাতৃভাবে অভিবাদন করেন। তদনন্তর নানা বিষয়ে কথাবাৰ্ত্ত হইল। জননীদেবী প্ৰবীণা হিন্দু স্ত্রীলোক, তথাপি তাহার স্বভাব অতি উদার, মন অতিশয় উন্নত, এবং মনে কিছুমাত্র কুসংস্কার নাই। কি ধনশালী, অন্যধৰ্ম্মাবলম্বী, সকলেরই প্রতি সমদৃষ্টি।” ১ শভুচন্দ্ৰ অন্যত্র লিখিতেছেন— * ১২৬৬ সাল হইতে ১২৭২ সাল পৰ্যন্ত ক্ৰমিক বিস্তর বিধবা কামিনীর বিবাহকাৰ্য সমাধা হয়। ঐ সকল বিবাহিত লোককে বিপদ হইতে রক্ষার জন্য, অগ্রজমহাশয় বিশেষরূপ যত্নবান ছিলেন। উহাদিগকে মধ্যে মধ্যে আপনার দেশস্থ ভবনে আনাইতেন। বিবাহিতা ঐ সকল স্ত্রীলোককে যদি কেহ ঘূণা করে, একারণ জননীদেবী। ঐ সকল বিবাহিতা ব্ৰাহ্ম য়া স্ত্রীলোকের সহিত একত্র এক পাত্রে ভোজন করিতেন।” ১ অথচ তখন বিধবাবিবাহের আন্দোলনে দেশের পুরুষেরা বিদ্যাসাগরের প্রাণসংহারের জন্য গোপনে আয়োজন করিতেছিল, এবং দেশের পণ্ডিতবর্গ শাস্ত্র মন্থন করিয়া কুযুক্তি এবং ভাষা মন্থন করিয়া কটুক্তি বিদ্যাসাগরের মস্তকের উপর বর্ষণ করিতেছিলেন। আর, এই রমণীকে কোনো শাস্ত্রের কোনো শ্লোক খুঁজিতে হয় নাই; বিধাতার স্বহস্তলিখিত শাস্ত্র তাহার হৃদয়ের মধ্যে রাত্ৰিদিন উদঘাটিত ছিল। অভিমনু্য জননীজঠরে থাকিতে যুদ্ধবিদ্যা শিখিয়াছিলেন, বিদ্যাসাগরও বিধিলিখিত সেই মহাশাস্ত্ৰ মাতৃগর্ভবাসকালেই অধ্যয়ন করিয়া আসিয়াছিলেন। আশঙ্কা করিতেছি, সমালোচক মহাশয়েরা মনে করিতে পারেন যে, বিদ্যাসাগরসম্বন্ধীয় ক্ষুদ্র প্রবন্ধে তাহার জননীসম্বন্ধে এতখানি আলোচনা কিছু পরিমাণবহির্ভূত হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু এ কথা তাহারা স্থির জানিবেন- এখানে জননীর চরিতে এবং পুত্রের চরিতে প্ৰভেদ নাই, তাহারা যেন পরস্পরের পুনরাবৃত্তি। তাহা ছাড়া মহাপুরুষের ইতিহাস বাহিরের নানা কার্যে এবং জীবনবৃত্তান্তে স্থায়ী হয়, আর, মহৎ-নারীর ইতিহাস তাহার পুত্রের চরিত্রে, তাহার স্বামীর কার্যে রচিত হইতে থাকে, এবং সে লেখায় তাহার নামোল্লেখ থাকে না। অতএব, বিদ্যাসাগরের জীবনে তাহার মাতার জীবনচরিত কেমন করিয়া লিখিত হইয়াছে তাহা ভালোরূপ আলোচনা না করিলে উভয়েরই জীবনী অসম্পূর্ণ থাকে। আর, আমরা যে মহাত্মার স্মৃতিপ্রতিমাপূজার জন্য এখানে সমবেত হইয়াছি যদি তিনি কোনোরূপ সূক্ষ্ম চিন্ময় দেহে অদ্য এই সভায় আসনগ্রহণ করিয়া থাকেন, এবং যদি এই অযোগ্য ভক্তকর্তৃক তাহার চরিতকীর্তন তাহার শ্রুতিগোচর হয়, তবে এই রচনার যে অংশে তাহার জীবনী অবলম্বন করিয়া তাহার মাতৃদেবীর মাহাত্ম্য মহীয়ান হইয়াছে সেইখানেই তাহার দিব্যনেত্ৰ হইতে ১. সহােদর শাস্তুচন্দ্ৰ বিদ্যারত্ন -প্ৰণীত বিদ্যাসাগরজীবনচরিত