পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Գ 8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী প্রভূততম পুণ্যাশ্রুবর্ষণ হইতে থাকিবে তাঁহাতে সন্দেহমাত্র নাই। বিদ্যাসাগর তাহার বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগে গোপাল-নামক একটি সুবোধ ছেলের দৃষ্টান্ত দিয়াছেন, তাহাকে বাপ-মায়ে যাহা বলে সে তাহাই করে। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্ৰ নিজে যখন সেই গোপালের বয়সী। ছিলেন তখন গোপালের অপেক্ষা কোনো কোনো অংশে রাখালের সঙ্গেই র্তাহার অধিকতর সাদৃশ্য দেখা যাইত। পিতার কথা পালন করা দূরে থাক, পিতা যাহা বলিতেন। তিনি তাহার ঠিক উলটা করিয়া বসিতেন। শম্ভুচন্দ্ৰ লিখিয়াছেন— “পিতা তাহার স্বভাব বুঝিয়া চলিতেন। যে দিন সাদা বস্ত্র না থাকিত, সে দিন বলিতেন, আজ ভাল কাপড় পরিয়া কলেজে যাইতে হইবে। তিনি হঠাৎ বলিতেন, না, আজ ময়লা কাপড় পরিয়া যাইব । যে দিন বলিতেন, আজ স্নান করিতে হইবে, শ্রবণমাত্র দাদা বলিতেন যে, আজ স্নান করিব না ; পিতা প্ৰহার করিয়াও স্নান করাইতে পারিতেন না। সঙ্গে করিয়া টাকশালের ঘাটে নামাইয়া দিলেও দাড়াইয়া থাকিতেন। পিতা চড়াচাপড় মারিয়া জোর করিয়া স্নান করাইতেন।” ১ পাঁচ-ছয় বৎসর বয়সের সময় যখন গ্রামের পাঠশালায় পড়িতে যাইতেন তখন প্রতিবেশী মথুর মণ্ডলের স্ত্রীকে রাগাইয়া দিবার জন্য যো-প্রকার সভ্য বিগৰ্হিত উপদ্রব তিনি করিতেন, বর্ণপরিচয়ের সর্বজননিন্দিত রাখাল বেচারাও বোধ করি এমন কাজ কখনো করে নাই। নিরীহ বাংলাদেশে গোপালের মতো সুবোধ ছেলের অভাব নাই। এই ক্ষীণতেজ দেশে রাখাল এবং তাহার জীবনীলেখক ঈশ্বরচন্দ্রের মতো দূর্দান্ত ছেলের প্রাদুর্ভাব হইলে বাঙালিজাতির শীর্ণচরিত্রের অপবাদ ঘুচিয়া যাইতে পারে। সুবোধ ছেলেগুলি পাস করিয়া ভালো চাকরি-বাকরি ও বিবাহকালে প্রচুর পণ লাভ করে সন্দেহ নাই, কিন্তু দুষ্ট অবাধ্য অশান্ত ছেলেগুলির কাছে স্বদেশের জন্য অনেক আশা করা যায়। বহুকাল পূর্বে একদা নবদ্বীপের শচীমাতার এক প্রবল দুরন্ত ছেলে এই আশা পূৰ্ণ করিয়াছিলেন। কিন্তু একটা বিষয়ে রাখালের সহিত তাহার জীবনচরিত-লেখকের সাদৃশ্য ছিল না। “রাখাল পড়িতে যাইবার সময় পথে খেলা করে, মিছামিছি দেরি করিয়া, সকলের শেষে পাঠশালায় যায়।” কিন্তু পড়াশুনায় বালক ঈশ্বরচন্দ্রের কিছুমাত্ৰ শৈথিল্য ছিল না। যে প্রবল জিদের সহিত তিনি পিতার যাইতেন। সেও তাহার প্রতিকুল অবস্থার বিরুদ্ধে নিজের জিদ রক্ষা। ক্ষুদ্র একওঁয়ে ছেলেটি মাথায় এক মস্ত ছাতা তুলিয়া তাহাদের বড়োবাজারের বাসা হইতে পটলডাঙায় সংস্কৃত-কলেজে যাত্রা করিতেন ; লোকে মনে করিত, একটা ছাতা চলিয়া যাইতেছে। এই দুৰ্জয় বালকের শরীরটি খর্ব শীর্ণ মাথাটা প্ৰকাণ্ড ; স্কুলের ছেলেরা সেইজন্য র্তাহাকে যীশুরে কই ও তাহার অপভ্রংশে কণ্ডারে জই বলিয়া খোপাইত ; তিনি তখন তোৎলা ছিলেন, রাগিয়া কথা বলিতে পারিতেন না ; > এই বালক রাত্রি দশটার সময় শুইতে যাইতেন। পিতাকে বলিয়া যাইতেন, রাত্রি দুই প্ৰহরের জাগাইতেন, বালক অবশিষ্ট রাত্ৰি জাগিয়া পড়া করিতেন। ইহাও একগুয়ে ছেলের নিজের শরীরের প্রতি জিদ। শরীরও তাহার প্রতিশোধ তুলিতে ছাড়িত না। মাঝে মাঝে কঠিন সাংঘাতিক পীড়া ইহার উপরে গৃহকর্মও অনেক ছিল। বাসায় তাহার পিতা ও মধ্যম ভ্ৰাতা ছিলেন। দাসদাসী ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্ৰ দুই বেলা সকলের রন্ধনাদি কাৰ্য করিতেন। সহােদর শাস্তুচন্দ্ৰ তাহার বর্ণনা করিয়াছেন। প্ৰত্যুষে নিদ্রাভঙ্গ হইলে ঈশ্বরচন্দ্ৰ কিয়ৎক্ষণ পুস্তক আবৃত্তি করিয়া গঙ্গার ঘাটে স্নান করিয়া ধরাইয়া রন্ধন করিতেন। বাসায় তাহারা চারি জন খাইতেন। আহারের পর উচ্ছিষ্ট মুক্ত ও বাসন ধৌত ১. সহােদর শাস্তুচন্দ্ৰ বিদ্যারত্ব -প্ৰণীত বিদ্যাসাগরজীবনচরিত