পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Գ Ե- রবীন্দ্র-রচনাবলী লাইবার ইচ্ছা আছে কি না, অগ্ৰে জানা আবশ্যক। শুনিয়া বিদ্যাসাগর সেইদিনই ত্ৰিশ ক্রোশ পথ দূরে কালনায় তর্কবাচস্পতির চতুষ্পাঠী-অভিমুখে পদব্ৰজে যাত্ৰা করিলেন। পরদিনে তর্কবাচস্পতির সম্মতি ও তাহার প্রশংসাপত্রগুলি লইয়া পুনরায় যথাসময়ে সাহেবের নিকট উপস্থিত হইলেন। ১ পরের উপকারকার্যে তিনি আপনার সমস্ত বল ও উৎসাহ প্ৰয়োগ করিতেন। ইহার মধ্যেও তাহার আজন্মকালের একটা জিদ প্ৰকাশ পাইত। সাধারণত আমাদের দয়ার মধ্যে এই জিদ না থাকাতে তাহা সংকীর্ণ ও স্বল্পফলপ্রসূ হইয়া বিশীর্ণ হইয়া যায়, তাহা পৌরুষমহত্ত্ব লাভ করে না। কারণ, দয়া বিশেষরূপে স্ত্রীলোকের নহে; প্রকৃত দয়া যথার্থ পুরুষেরই ধর্ম। দয়ার বিধান পূর্ণরূপে পালন করিতে হইলে দৃঢ় বীর্য এবং কঠিন অধ্যবসায় আবশ্যক। তাহাতে অনেক সময় সুদূরব্যাপী ও সুদীর্ঘ কর্মপ্রণালী অনুসরণ করিয়া চলিতে হয়। তাহা কেবল ক্ষণকালের আত্মত্যাগের দ্বারা প্ৰবৃত্তির উচ্ছাসনিকৃত্তি এবং হৃদয়ের ভারলাঘব করা নহে, তাহা দীর্ঘকাল ধরিয়া নানা উপায়ে নানা বাধা অতিক্রম করিয়া দুরূহ উদ্দেশ্যসিদ্ধির অপেক্ষা রাখে। একবার গবমেন্টের কোনো অত্যুৎসাহী ভূত্য জাহানাবাদ মহকুমায় ইনকমট্যাক্স ধার্যের জন্য উপস্থিত হন। আয়ের স্বল্পতাপ্রযুক্ত যে-সকল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইনকমট্যাক্সের অধীনে না আসিতে পারে, গবমেন্টের এই সুচতুর শিকারি তাহাদের দুই-তিনজনের নাম একত্ৰ করিয়া ট্যাক্সের জালে বদ্ধ করিতেছিলেন। বিদ্যাসাগর। ইহা শুনিয়া তৎক্ষণাৎ খড়ার গ্রামে অ্যাসেসরবাবুর নিকটে আসিয়া আপত্তি প্রকাশ করেন। বাবুটি তাঁহাতে কৰ্ণপাত না করিয়া অভিযোগকারী:দিগকে ধমক দিয়া বাধা করিলেন। বিদ্যাসাগর তৎক্ষণাৎ কলিকাতায় আসিয়া লেফটেনেন্ট গবর্নরের নিকট বাদী হইলেন। লেফটেনেন্ট গবর্নর বর্ধমানের কালেক্টর হ্যারিসন সাহেবকে তদন্ত-জন্য প্রেরণ করেন। বিদ্যাসাগর হ্যারিসনের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ব্যবসায়ীদের খাতপত্র পরীক্ষা করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন– এইরূপে দুইমাস কাল অনন্যমনা ও অনন্যকর্ম হইয়া তিনি এই অন্যায়নিবারণে কৃতকার্য হইয়াছিলেন। ১ বিদ্যাসাগরের জীবনে এরূপ দৃষ্টান্ত আরো অনেক দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু এরূপ দৃষ্টান্ত বাংলায় অন্যত্র হইতে সংগ্রহ করা দুষ্কর। আমাদের হৃদয় অত্যন্ত কোমল বলিয়া আমরা প্রচার করিয়া থাকি, কিন্তু আমরা কোনো ঝঞ্ঝাটে যাইতে চাহি না । এই অলস শান্তিপ্ৰিয়তা আমাদিগকে অনেক সময়েই স্বার্থপর নিষ্ঠুরতায় অবতীর্ণ করে। একজন জাহাজি গোরা কিছুমাত্ৰ চিন্তা না করিয়া মজ্জামান ব্যক্তির পশ্চাতে জলে ঝাপ দিয়া পড়ে ; কিন্তু একখানা নৌকা যেখানে বিপন্ন অন্য নৌকাগুলি তাহার কিছুমাত্র সাহায্য চেষ্টা না করিয়া চলিয়া যায়, এরূপ ঘটনা আমাদের দেশে সর্বদাই শুনিতে পাই। দয়ার সহিত বীর্যের সম্মিলন না হইলে সে দয়া অনেক স্থলেই অকিঞ্চিৎকর হইয়া থাকে । কেবল যে সংকট এবং অধ্যবসায়ের ক্ষেত্রে আমাদের অন্তঃপুরচারিণী দয়া প্ৰবেশ করিতে চাহে না। তাহা নহে। সামাজিক কৃত্রিম শুচিতারক্ষার নিয়ম -লঙ্ঘনও তাহার পক্ষে দুঃসাধ্য। আমি জানি, কোনো এক গ্ৰাম্য মেলায় এক বিদেশী ব্ৰাহ্মণের মৃত্যু হইলে ঘূণা করিয়া কেহই তাহার অস্ত্যেষ্টিসৎকারের ব্যবস্থা করে নাই, অবশেষে তাহার অনুপস্থিত য়পরিজনের অন্তরে আমরা অতি সহজেই “আহা উহু’ এবং অশ্রুপাত করিতে পারি, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে পরোপকারের পথে আমরা সহস্ৰ স্বাভাবিক এবং কৃত্রিম বাধার দ্বারা পদে পদে প্ৰতিহত। বিদ্যাসাগরের কারুণ্য বলিষ্ঠ, পুরুষোচিত, এইজন্য তাহা সরল এবং নির্বিকার ; তাহা কোথাও সূক্ষ্ম তর্ক তুলিত না, নাসিকাকুঞ্চন করিত না, বসন তুলিয়া ধরিত না— একেবারে দ্রুতপদে, ঋজু রেখায়, নিঃশঙ্কে, নিঃসংকোচে আপন কার্যে গিয়া প্ৰবৃত্ত হইত। রোগের বীভৎস মলিনতা তাহাকে কখনো রোগীর নিকট হইতে দূরে রাখে। নাই। এমন-কি, চণ্ডীচরণবাবুর গ্রন্থে লিখিত আছে, কার্মটাড়ে এক মেথরজাতীয়া স্ত্রীলোক ওলাউঠায় আক্রান্ত হইলে বিদ্যাসাগর স্বয়ং তাহার কুটিরে উপস্থিত থাকিয়া স্বহস্তে তাহার সেবা করিতে কুষ্ঠিত ১। সহােদর শাভুচন্দ্ৰ বিদ্যারত্ব -প্ৰণীত বিদ্যাসাগরজীবনচরিত